ঢাকায় ‘জামিয়া আরাবিয়া নুরুল ইসলাম’ কমপ্লেক্স উদ্বোধন
সমাজের পিছিয়ে পড়া শিশু ও এতিমদের ধর্মীয় ও আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে রাজধানীর উত্তরায় জামিয়া আরাবিয়া নুরুল ইসলাম কমপ্লেক্সের যাত্রা শুরু। যমুনা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম ফাউন্ডেশনের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত এ কমপ্লেক্সে মাদ্রাসা, মসজিদ ও এতিমখানা রয়েছে।
যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান, সাবেক মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম শনিবার প্রতিষ্ঠানটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। এখানে একসঙ্গে ৫০০ শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে থাকা-খাওয়াসহ ইসলামিক ও আধুনিক শিক্ষা দেওয়া হবে। প্রতিষ্ঠানটি থেকে পাশ করা শিক্ষার্থীদের যমুনা গ্রুপে চাকরির প্রতিশ্রুতি দেন সালমা ইসলাম।
এ সময় যুগান্তর সম্পাদক ও জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলম বলেন, আল্লাহ বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলামকে পছন্দ করেন বলেই এ ধরনের প্রকল্পে বিনিয়োগের সুযোগ দিয়েছেন।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন যুগান্তরের যুগ্ম সম্পাদক মহিউদ্দিন সরকার, উপসম্পাদক এহসানুল হক বাবু, আহমেদ দীপু ও বিএম জাহাঙ্গীর, প্রধান বার্তা-সম্পাদক আবদুর রহমান, নগর সম্পাদক মিজান মালিক, প্রধান প্রতিবেদক মাসুদ করিম, যমুনা গ্রুপের পরিচালক (প্রকৌশল) মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রউফ এবং জামিয়া আরাবিয়ার প্রকল্প প্রধান তোফায়েল গাজালি।
অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন যুগান্তরের বিশেষ প্রতিনিধি শেখ মামুনুর রশীদ, আবদুল্লাহ আল মামুন ও যমুনা গ্রুপের কর্মকর্তারা।
অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম আজীবন মানুষের কল্যাণে কাজ করে গেছেন। অনুষ্ঠানে ১৪ জন হাফেজকে ক্রেস্ট প্রদান করা হয়। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন সিনিয়র শিক্ষক মাওলানা জুবায়ের আহমেদ।
অনুষ্ঠানে জানানো হয়, যমুনা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম ফাউন্ডেশনের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হবে এ কমপ্লেক্স। উত্তরার উত্তরখানে মেডিকেল রোড চানপাড়ায় নির্মিত এই কমপ্লেক্সে একসঙ্গে ৫০০ শিক্ষার্থী বিনামূল্যে ইসলামিক ও আধুনিক শিক্ষা নেবে। চারতলা ভবনের এ কমপ্লেক্সে থাকছে মাদ্রাসা, মসজিদ ও এতিমখানা। প্রতিষ্ঠানের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এখান থেকে শিক্ষার্থীরা বের হয়ে জীবন ও সমাজে সর্বত্র নেতৃত্ব দিতে পারবেন। কারণ এখানে ইসলামিক শিক্ষার পাশাপাশি আধুনিক শিক্ষায় গড়ে তোলা হবে শিক্ষার্থীদের। ফলে এখান থেকে বেরিয়ে যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এবং যে কোনো পেশায় যেতে পারবে। এর মধ্য দিয়ে যমুনা গ্র“পের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান নুরুল ইসলামের স্বপ্ন পূরণ হবে।
সাবেক মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম বলেন, আমার স্বামী নুরুল ইসলামকে একদিন আমি বলেছিলাম, আমি তোমাকে একটা উপহার দিতে চাই। তিনি বললেন, আমি মানুষকে এত কিছু দেই, সবার জন্য কাজ করি। আবার তুমি আমাকে কি উপহার দিবা। আমি বলেছিলাম, তোমার দেওয়া বাজারের টাকা থেকে কিছু জমিয়ে উত্তরখানে একটা জায়গা কিনেছি। সাড়ে ১৪ কাঠা। এটি তোমাকে উপহার দিতে চাই। উনি বললেন, আমার এত জায়গা, এত সম্পদ আল্লাহ দিয়েছেন তারপরও তুমি কষ্ট করে কেন এসব জায়গা কিনতে গেলে? কিন্তু এতদিন পরে সেই জায়গায় নুরুল ইসলামের নামে মসজিদ, মাদ্রাসা ও এতিমদের পড়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। এটি মহান আল্লাহর কুদরত। তিনি আমাকে দিয়ে এই কাজ করাবেন বলেই জমি কেনার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। নুরুল ইসলাম সাহেব স্ত্রীকে জীবনে অনেক কিছু দিয়েছেন। আর আল্লাহ হয়তো চেয়েছেন, শেষ জীবনে স্ত্রী তাকে দান করুক। এই দান অনন্ত জীবনে প্রশান্তির কারণ হবে। সালমা ইসলাম আরও বলেন, এখানে মসজিদ, মাদ্রাসা ও এতিমদের পড়ার সুযোগ হয়েছে। আমি এটা কখনো চিন্তা করতে পারিনি। কিন্তু আল্লাহ চেয়েছেন বলেই আমাকে দিয়ে এ কাজ করিয়েছেন। এসব বিষয় চিন্তা করে অবাক হই।
তিনি আরও বলেন, নুরুল ইসলাম সাহেব মারা যাওয়ার পর আমার মেজ মেয়ে মনিকা ইসলাম একদিন বলল, তার বাবার নামে একটা মসজিদ-মাদ্রাসা করতে হবে। এটা করার জন্য ও আমাকে তাড়া দিচ্ছিল। জায়গার ব্যবস্থা করতে বলছিল। পরে ওকে উত্তরখানের এই জায়গাটার কথা বলি। ওই সময়ে এই জায়গায় সেমিপাকা ভবন তৈরি করে দিয়েছিলাম। পরে এই জায়গায় মসজিদ, মাদ্রাসা ও এতিমখানা তৈরির প্রস্তাবে ওরা রাজি হয়। কিছুদিনের মধ্যে এখানে মসজিদ, মাদ্রাসা, এতিমখানা ও রমজানে ইফতারের আয়োজন করা হয়। সেই থেকে যাত্রা শুরু।
শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে সালমা ইসলাম বলেন, তোমরা আল্লাহকে পাওয়ার রাস্তায় রয়েছো। সব সময় সত্য কথা বলবে, সৎ পথে চলবে। তোমাদের এখানে ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি সাধারণ শিক্ষাও দেওয়া হবে। নুরুল ইসলাম সাহেব অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান রেখে গেছেন; সেখানেও তোমরা চাকরির সুযোগ পাবে। সেসব জায়গায় তোমরা কাজ করতে পারবে। তিনি বলেন, তোমরা নুরুল ইসলামের আত্মার শান্তির জন্য দোয়া করবে। আমার ও আমার পরিবারের জন্যও দোয়া করবা। তোমাদের পাশে যমুনা গ্রুপ সব সময় থাকবে, ইনশাআল্লাহ।
সাইফুল আলম বলেন, মসজিদ-মাদ্রাসা অত্যন্ত পবিত্র জায়গা। এ ধরনের কাজে বিনিয়োগের জন্য মহান আল্লাহর ইচ্ছা দরকার। তিনি যাকে পছন্দ করেন, তার মাধ্যমে এসব প্রকল্পে বিনিয়োগ করান। পৃথিবীতে অর্থ, প্রতিপত্তি, পেশিশক্তি ও ক্ষমতা অনেকের থাকে। কিন্তু সবাই মহান কাজে বিনিয়োগ করতে পারেন না। এজন্য আল্লাহর ইচ্ছা দরকার। নুরুল ইসলামকে আল্লাহ পছন্দ করেন বলেই এ ধরনের প্রকল্পে বিনিয়োগের সুযোগ দিয়েছেন। আল্লাহ তাকে পছন্দ করেন বলেই তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা হয়েছেন। ৪টি সুসন্তান ও নেককার স্ত্রী দিয়েছেন। শহিদি মৃত্যু এবং মসজিদের পাশে কবর হয়েছে। কবরে বসে তিনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আজান শুনতে পাচ্ছেন। মৃত্যুর পর নুরুল ইসলাম রাষ্ট্রীয় সম্মান পেয়েছেন। তার নামে ফাউন্ডেশন হয়েছে। এই ফাউন্ডেশন মানুষের কল্যাণে কাজ করছে, খাবার দিচ্ছে, কুরআন শরিফ দিচ্ছে। শীতে কম্বল বিতরণ করছে। একজন শীতার্ত মানুষের গায়ে যখন কম্বল বিছিয়ে দেওয়া হয়, তখন আল্লাহর আরশ পর্যন্ত খুশি হয়ে যায়। একটি মানুষের জীবনে এটি বিশাল সার্থকতা।
সাইফুল আলম আরও বলেন, ইহকালেও সফল ছিলেন ক্ষণজন্মা এই মানুষটি। তার বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে সেটি বারবার প্রমাণিত হয়েছে।
যুগান্তর সম্পাদক বলেন, কুরআন ও হাদিসের ব্যাখ্যা অনুসারে একজন মানুষ ৫টি ওয়াদা পালন করলে প্রকৃত দ্বীনদার হবেন। এরমধ্যে প্রথম হলো-আল্লাহর সঙ্গে দেওয়া ওয়াদা পালন, আল্লাহর কিতাবের ওয়াদা পালন ও কল্যাণ কামনা, রাসূল (সা.) এর সঙ্গে ওয়াদা পালন, মুসলমানদের আমির বা খলিফাদের সঙ্গে ওয়াদা পালন ও সবশেষে জনগণের সঙ্গে ওয়াদা পালন ও কল্যাণ কামনা। এখানে ৫টি কাজের সঙ্গে কল্যাণ শব্দটি জুড়ে দেওয়া হয়েছে। এই কথা বলার কারণ হলো, নুরুল ইসলামের লক্ষ্যই ছিল দেশের কল্যাণ করা, মানুষের কল্যাণ, রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং ধর্মের কল্যাণ করা। আমি তার রুহের মাগফিরাত কামনা করি। তিনি যে আদর্শ পরিবার রেখে গেছেন, তারা যাতে ন্যায়সংগতভাবে, সততা, নিষ্ঠা ও ধর্মীয় বিশ্বাসের সঙ্গে মানুষ, রাষ্ট্র, ধর্ম ও জনগণের কল্যাণে কাজ করতে পারেন সেই দোয়া করছি।
মহিউদ্দিন সরকার বলেন, জীবনে দেশ-বিদেশে অনেক অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। কিন্তু আজকের অনুষ্ঠানটি সবচেয়ে ভালো লেগেছে। বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলামের স্মরণে সন্তানরা এ বিশাল কমপ্লেক্স করেছেন। এটি বিশাল ব্যাপার। কবরে বসে তিনি এ সৎ কাজের সওয়াব পাবেন। মহিউদ্দিন সরকার বলেন, নুরুল ইসলাম আজীবন মানুষের কল্যাণে কাজ করেছেন। মাঝে মাঝে চিন্তা করি একটা মানুষের জীবনে এতগুলো সৎ কর্ম কীভাবে সম্ভব। এ সময়ে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তি জ্ঞান শেখানোর ওপর জোর দেন তিনি।
এহসানুল হক বাবু বলেন, একেবারে গ্রাম এলাকায় কমপ্লেক্স করেছে যমুনা গ্রুপ। এটি চিন্তাই করা যায় না। বেঁচে থাকতে নুরুল ইসলাম সব সময় বলতেন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। তিনি সেটাই করেছেন। প্রত্যক্ষভাবে প্রায় ১ লাখ লোক এই গ্রুপে কাজ করছেন। এছাড়াও এই বীর মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুর পর সন্তানরা তার জন্য মসজিদ-মাদ্রাসা ও এতিমখানা করেছেন। হাদিসে আছে, যে ব্যক্তি একটি মসজিদ নির্মাণ করবেন, আল্লাহ তার জন্য বেহেশতে ওই রকম একটি ঘর নির্মাণ করবেন। এছাড়াও এই মসজিদে মানুষ যতদিন নামাজ পড়বেন, ততদিন তার আমলনামায় সওয়াব পৌঁছাতে থাকবে।
আহমেদ দীপু বলেন, নুরুল ইসলাম মহামারিতে মারা গেছেন। এই মহামারি নিয়ে একেক দেশে একেকরকম কথাবার্তা রয়েছে। তবে খোলাফায়ে রাশেদিনের আমলে সবাই একমত পোষণ করেছেন, যারা মহামারিতে মারা যাবেন, তারা শহিদি মর্যাদা পাবেন। এছাড়াও তার প্রতিষ্ঠান সব সময় সদকায়ে জারিয়া হিসাবে থাকবে। তিনি এর সওয়াব পাবেন।
বিএম জাহাঙ্গীর বলেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম ৪২টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়েছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে দামি প্রতিষ্ঠান আজকের এই কমপ্লেক্স। এর সঙ্গে কোনো কিছুর তুলনা হয় না। এটি অনন্তকালের সম্পদ। কেয়ামত পর্যন্ত সদকায়ে জারিয়া থাকবে। তিনি বলেন, আজকে শিশুদের দেখে নুরুল ইসলামের কথা মনে পড়ছে। বাইরে অনেকে তার রাগ দেখেছেন। কিন্তু তার মন ও আচরণ ছিল শিশুর মতো সরল। বিএম জাহাঙ্গীর বলেন, কুরআন-হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়ে অনেক বক্তা বলেছেন, মানুষের মৃত্যুর পর তিনটি জিনিস সদকায়ে জারিয়া হিসাবে কাজ করে। এগুলো হলো-নেক সন্তান, এলেম বা জ্ঞান এবং মসজিদ-মাদ্রাসাসহ সদকায়ে জারিয়ার প্রতিষ্ঠান। এক্ষেত্রে নুরুল ইসলামের সন্তানরা আল্লাহর পথে রয়েছেন এবং সব সময়ই বাবাকে স্মরণ করেন।
আবদুর রহমান বলেন, আজকে এমন একটি প্রতিষ্ঠানে আমরা এসেছি, যেখানে সব সময় কুরআন-হাদিসের চর্চা হয়। তিনি বলেন, দুনিয়ার কোনো স্বার্থে নয়, নুরুল ইসলামের পরিবার আখেরাতের কথা চিন্তা করে মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণ করেছেন। এর সওয়াব তিনি কবরে বসে পেতে থাকবেন।
মিজান মালিক বলেন, নুরুল ইসলাম সাহেব আজীবন মানুষের কল্যাণে কাজ করেছেন। তার রেখে যাওয়া কাজ সন্তানরা শেষ করছেন। আমি মনে করি, তার আত্মা পবিত্র এবং জান্নাতে আছে।
মাসুদ করিম বলেন, ১৯৭১ সালে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন নুরুল ইসলাম। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য কাজ শুরু করেন। একে একে ৪২টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এসব প্রতিষ্ঠানে বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।
আব্দুর রউফ বলেন, ২০২১ সালের নভেম্বরে এ মসজিদ নির্মাণ কাজ শুরু হয়। আর ২০২২ সালের এপ্রিলে শুরু হয় নুরুল ইসলাম ফাউন্ডেশনের কাজ। এছাড়াও ফাউন্ডেশনের আওতায় সারা দেশে আরও মসজিদ-মাদ্রাসার কাজ চলছে।
তোফায়েল গাজালি বলেন, সবাইকে আল্লাহতায়ালা মসজিদ-মাদ্রাসা করার তৌফিক দেন না। তিনি যাকে পছন্দ করেন, তাদের মাধ্যমেই এই খেদমত করিয়ে থাকেন। বাংলাদেশে অলি-আউলিয়াদের মাধ্যমে মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মিত হয়েছে। সেক্ষেত্রে নুরুল ইসলাম অত্যন্ত সৌভাগ্যবান। কারণ তার মাধ্যমে এই দ্বীনি কমপ্লেক্স হয়েছে। তিনি বলেন, এই মসজিদ ছাড়াও সারা দেশে মসজিদভিত্তিক ১২শ মক্তব পরিচালনা করে যমুনা গ্রুপ।
যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান, সাবেক মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম শনিবার প্রতিষ্ঠানটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। এখানে একসঙ্গে ৫০০ শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে থাকা-খাওয়াসহ ইসলামিক ও আধুনিক শিক্ষা দেওয়া হবে। প্রতিষ্ঠানটি থেকে পাশ করা শিক্ষার্থীদের যমুনা গ্রুপে চাকরির প্রতিশ্রুতি দেন সালমা ইসলাম।
এ সময় যুগান্তর সম্পাদক ও জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলম বলেন, আল্লাহ বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলামকে পছন্দ করেন বলেই এ ধরনের প্রকল্পে বিনিয়োগের সুযোগ দিয়েছেন।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন যুগান্তরের যুগ্ম সম্পাদক মহিউদ্দিন সরকার, উপসম্পাদক এহসানুল হক বাবু, আহমেদ দীপু ও বিএম জাহাঙ্গীর, প্রধান বার্তা-সম্পাদক আবদুর রহমান, নগর সম্পাদক মিজান মালিক, প্রধান প্রতিবেদক মাসুদ করিম, যমুনা গ্রুপের পরিচালক (প্রকৌশল) মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রউফ এবং জামিয়া আরাবিয়ার প্রকল্প প্রধান তোফায়েল গাজালি।
অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন যুগান্তরের বিশেষ প্রতিনিধি শেখ মামুনুর রশীদ, আবদুল্লাহ আল মামুন ও যমুনা গ্রুপের কর্মকর্তারা।
অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম আজীবন মানুষের কল্যাণে কাজ করে গেছেন। অনুষ্ঠানে ১৪ জন হাফেজকে ক্রেস্ট প্রদান করা হয়। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন সিনিয়র শিক্ষক মাওলানা জুবায়ের আহমেদ।
অনুষ্ঠানে জানানো হয়, যমুনা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম ফাউন্ডেশনের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হবে এ কমপ্লেক্স। উত্তরার উত্তরখানে মেডিকেল রোড চানপাড়ায় নির্মিত এই কমপ্লেক্সে একসঙ্গে ৫০০ শিক্ষার্থী বিনামূল্যে ইসলামিক ও আধুনিক শিক্ষা নেবে। চারতলা ভবনের এ কমপ্লেক্সে থাকছে মাদ্রাসা, মসজিদ ও এতিমখানা। প্রতিষ্ঠানের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এখান থেকে শিক্ষার্থীরা বের হয়ে জীবন ও সমাজে সর্বত্র নেতৃত্ব দিতে পারবেন। কারণ এখানে ইসলামিক শিক্ষার পাশাপাশি আধুনিক শিক্ষায় গড়ে তোলা হবে শিক্ষার্থীদের। ফলে এখান থেকে বেরিয়ে যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এবং যে কোনো পেশায় যেতে পারবে। এর মধ্য দিয়ে যমুনা গ্র“পের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান নুরুল ইসলামের স্বপ্ন পূরণ হবে।
সাবেক মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম বলেন, আমার স্বামী নুরুল ইসলামকে একদিন আমি বলেছিলাম, আমি তোমাকে একটা উপহার দিতে চাই। তিনি বললেন, আমি মানুষকে এত কিছু দেই, সবার জন্য কাজ করি। আবার তুমি আমাকে কি উপহার দিবা। আমি বলেছিলাম, তোমার দেওয়া বাজারের টাকা থেকে কিছু জমিয়ে উত্তরখানে একটা জায়গা কিনেছি। সাড়ে ১৪ কাঠা। এটি তোমাকে উপহার দিতে চাই। উনি বললেন, আমার এত জায়গা, এত সম্পদ আল্লাহ দিয়েছেন তারপরও তুমি কষ্ট করে কেন এসব জায়গা কিনতে গেলে? কিন্তু এতদিন পরে সেই জায়গায় নুরুল ইসলামের নামে মসজিদ, মাদ্রাসা ও এতিমদের পড়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। এটি মহান আল্লাহর কুদরত। তিনি আমাকে দিয়ে এই কাজ করাবেন বলেই জমি কেনার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। নুরুল ইসলাম সাহেব স্ত্রীকে জীবনে অনেক কিছু দিয়েছেন। আর আল্লাহ হয়তো চেয়েছেন, শেষ জীবনে স্ত্রী তাকে দান করুক। এই দান অনন্ত জীবনে প্রশান্তির কারণ হবে। সালমা ইসলাম আরও বলেন, এখানে মসজিদ, মাদ্রাসা ও এতিমদের পড়ার সুযোগ হয়েছে। আমি এটা কখনো চিন্তা করতে পারিনি। কিন্তু আল্লাহ চেয়েছেন বলেই আমাকে দিয়ে এ কাজ করিয়েছেন। এসব বিষয় চিন্তা করে অবাক হই।
তিনি আরও বলেন, নুরুল ইসলাম সাহেব মারা যাওয়ার পর আমার মেজ মেয়ে মনিকা ইসলাম একদিন বলল, তার বাবার নামে একটা মসজিদ-মাদ্রাসা করতে হবে। এটা করার জন্য ও আমাকে তাড়া দিচ্ছিল। জায়গার ব্যবস্থা করতে বলছিল। পরে ওকে উত্তরখানের এই জায়গাটার কথা বলি। ওই সময়ে এই জায়গায় সেমিপাকা ভবন তৈরি করে দিয়েছিলাম। পরে এই জায়গায় মসজিদ, মাদ্রাসা ও এতিমখানা তৈরির প্রস্তাবে ওরা রাজি হয়। কিছুদিনের মধ্যে এখানে মসজিদ, মাদ্রাসা, এতিমখানা ও রমজানে ইফতারের আয়োজন করা হয়। সেই থেকে যাত্রা শুরু।
শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে সালমা ইসলাম বলেন, তোমরা আল্লাহকে পাওয়ার রাস্তায় রয়েছো। সব সময় সত্য কথা বলবে, সৎ পথে চলবে। তোমাদের এখানে ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি সাধারণ শিক্ষাও দেওয়া হবে। নুরুল ইসলাম সাহেব অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান রেখে গেছেন; সেখানেও তোমরা চাকরির সুযোগ পাবে। সেসব জায়গায় তোমরা কাজ করতে পারবে। তিনি বলেন, তোমরা নুরুল ইসলামের আত্মার শান্তির জন্য দোয়া করবে। আমার ও আমার পরিবারের জন্যও দোয়া করবা। তোমাদের পাশে যমুনা গ্রুপ সব সময় থাকবে, ইনশাআল্লাহ।
সাইফুল আলম বলেন, মসজিদ-মাদ্রাসা অত্যন্ত পবিত্র জায়গা। এ ধরনের কাজে বিনিয়োগের জন্য মহান আল্লাহর ইচ্ছা দরকার। তিনি যাকে পছন্দ করেন, তার মাধ্যমে এসব প্রকল্পে বিনিয়োগ করান। পৃথিবীতে অর্থ, প্রতিপত্তি, পেশিশক্তি ও ক্ষমতা অনেকের থাকে। কিন্তু সবাই মহান কাজে বিনিয়োগ করতে পারেন না। এজন্য আল্লাহর ইচ্ছা দরকার। নুরুল ইসলামকে আল্লাহ পছন্দ করেন বলেই এ ধরনের প্রকল্পে বিনিয়োগের সুযোগ দিয়েছেন। আল্লাহ তাকে পছন্দ করেন বলেই তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা হয়েছেন। ৪টি সুসন্তান ও নেককার স্ত্রী দিয়েছেন। শহিদি মৃত্যু এবং মসজিদের পাশে কবর হয়েছে। কবরে বসে তিনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আজান শুনতে পাচ্ছেন। মৃত্যুর পর নুরুল ইসলাম রাষ্ট্রীয় সম্মান পেয়েছেন। তার নামে ফাউন্ডেশন হয়েছে। এই ফাউন্ডেশন মানুষের কল্যাণে কাজ করছে, খাবার দিচ্ছে, কুরআন শরিফ দিচ্ছে। শীতে কম্বল বিতরণ করছে। একজন শীতার্ত মানুষের গায়ে যখন কম্বল বিছিয়ে দেওয়া হয়, তখন আল্লাহর আরশ পর্যন্ত খুশি হয়ে যায়। একটি মানুষের জীবনে এটি বিশাল সার্থকতা।
সাইফুল আলম আরও বলেন, ইহকালেও সফল ছিলেন ক্ষণজন্মা এই মানুষটি। তার বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে সেটি বারবার প্রমাণিত হয়েছে।
যুগান্তর সম্পাদক বলেন, কুরআন ও হাদিসের ব্যাখ্যা অনুসারে একজন মানুষ ৫টি ওয়াদা পালন করলে প্রকৃত দ্বীনদার হবেন। এরমধ্যে প্রথম হলো-আল্লাহর সঙ্গে দেওয়া ওয়াদা পালন, আল্লাহর কিতাবের ওয়াদা পালন ও কল্যাণ কামনা, রাসূল (সা.) এর সঙ্গে ওয়াদা পালন, মুসলমানদের আমির বা খলিফাদের সঙ্গে ওয়াদা পালন ও সবশেষে জনগণের সঙ্গে ওয়াদা পালন ও কল্যাণ কামনা। এখানে ৫টি কাজের সঙ্গে কল্যাণ শব্দটি জুড়ে দেওয়া হয়েছে। এই কথা বলার কারণ হলো, নুরুল ইসলামের লক্ষ্যই ছিল দেশের কল্যাণ করা, মানুষের কল্যাণ, রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং ধর্মের কল্যাণ করা। আমি তার রুহের মাগফিরাত কামনা করি। তিনি যে আদর্শ পরিবার রেখে গেছেন, তারা যাতে ন্যায়সংগতভাবে, সততা, নিষ্ঠা ও ধর্মীয় বিশ্বাসের সঙ্গে মানুষ, রাষ্ট্র, ধর্ম ও জনগণের কল্যাণে কাজ করতে পারেন সেই দোয়া করছি।
মহিউদ্দিন সরকার বলেন, জীবনে দেশ-বিদেশে অনেক অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। কিন্তু আজকের অনুষ্ঠানটি সবচেয়ে ভালো লেগেছে। বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলামের স্মরণে সন্তানরা এ বিশাল কমপ্লেক্স করেছেন। এটি বিশাল ব্যাপার। কবরে বসে তিনি এ সৎ কাজের সওয়াব পাবেন। মহিউদ্দিন সরকার বলেন, নুরুল ইসলাম আজীবন মানুষের কল্যাণে কাজ করেছেন। মাঝে মাঝে চিন্তা করি একটা মানুষের জীবনে এতগুলো সৎ কর্ম কীভাবে সম্ভব। এ সময়ে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তি জ্ঞান শেখানোর ওপর জোর দেন তিনি।
এহসানুল হক বাবু বলেন, একেবারে গ্রাম এলাকায় কমপ্লেক্স করেছে যমুনা গ্রুপ। এটি চিন্তাই করা যায় না। বেঁচে থাকতে নুরুল ইসলাম সব সময় বলতেন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। তিনি সেটাই করেছেন। প্রত্যক্ষভাবে প্রায় ১ লাখ লোক এই গ্রুপে কাজ করছেন। এছাড়াও এই বীর মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুর পর সন্তানরা তার জন্য মসজিদ-মাদ্রাসা ও এতিমখানা করেছেন। হাদিসে আছে, যে ব্যক্তি একটি মসজিদ নির্মাণ করবেন, আল্লাহ তার জন্য বেহেশতে ওই রকম একটি ঘর নির্মাণ করবেন। এছাড়াও এই মসজিদে মানুষ যতদিন নামাজ পড়বেন, ততদিন তার আমলনামায় সওয়াব পৌঁছাতে থাকবে।
আহমেদ দীপু বলেন, নুরুল ইসলাম মহামারিতে মারা গেছেন। এই মহামারি নিয়ে একেক দেশে একেকরকম কথাবার্তা রয়েছে। তবে খোলাফায়ে রাশেদিনের আমলে সবাই একমত পোষণ করেছেন, যারা মহামারিতে মারা যাবেন, তারা শহিদি মর্যাদা পাবেন। এছাড়াও তার প্রতিষ্ঠান সব সময় সদকায়ে জারিয়া হিসাবে থাকবে। তিনি এর সওয়াব পাবেন।
বিএম জাহাঙ্গীর বলেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম ৪২টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়েছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে দামি প্রতিষ্ঠান আজকের এই কমপ্লেক্স। এর সঙ্গে কোনো কিছুর তুলনা হয় না। এটি অনন্তকালের সম্পদ। কেয়ামত পর্যন্ত সদকায়ে জারিয়া থাকবে। তিনি বলেন, আজকে শিশুদের দেখে নুরুল ইসলামের কথা মনে পড়ছে। বাইরে অনেকে তার রাগ দেখেছেন। কিন্তু তার মন ও আচরণ ছিল শিশুর মতো সরল। বিএম জাহাঙ্গীর বলেন, কুরআন-হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়ে অনেক বক্তা বলেছেন, মানুষের মৃত্যুর পর তিনটি জিনিস সদকায়ে জারিয়া হিসাবে কাজ করে। এগুলো হলো-নেক সন্তান, এলেম বা জ্ঞান এবং মসজিদ-মাদ্রাসাসহ সদকায়ে জারিয়ার প্রতিষ্ঠান। এক্ষেত্রে নুরুল ইসলামের সন্তানরা আল্লাহর পথে রয়েছেন এবং সব সময়ই বাবাকে স্মরণ করেন।
আবদুর রহমান বলেন, আজকে এমন একটি প্রতিষ্ঠানে আমরা এসেছি, যেখানে সব সময় কুরআন-হাদিসের চর্চা হয়। তিনি বলেন, দুনিয়ার কোনো স্বার্থে নয়, নুরুল ইসলামের পরিবার আখেরাতের কথা চিন্তা করে মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণ করেছেন। এর সওয়াব তিনি কবরে বসে পেতে থাকবেন।
মিজান মালিক বলেন, নুরুল ইসলাম সাহেব আজীবন মানুষের কল্যাণে কাজ করেছেন। তার রেখে যাওয়া কাজ সন্তানরা শেষ করছেন। আমি মনে করি, তার আত্মা পবিত্র এবং জান্নাতে আছে।
মাসুদ করিম বলেন, ১৯৭১ সালে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন নুরুল ইসলাম। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য কাজ শুরু করেন। একে একে ৪২টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এসব প্রতিষ্ঠানে বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।
আব্দুর রউফ বলেন, ২০২১ সালের নভেম্বরে এ মসজিদ নির্মাণ কাজ শুরু হয়। আর ২০২২ সালের এপ্রিলে শুরু হয় নুরুল ইসলাম ফাউন্ডেশনের কাজ। এছাড়াও ফাউন্ডেশনের আওতায় সারা দেশে আরও মসজিদ-মাদ্রাসার কাজ চলছে।
তোফায়েল গাজালি বলেন, সবাইকে আল্লাহতায়ালা মসজিদ-মাদ্রাসা করার তৌফিক দেন না। তিনি যাকে পছন্দ করেন, তাদের মাধ্যমেই এই খেদমত করিয়ে থাকেন। বাংলাদেশে অলি-আউলিয়াদের মাধ্যমে মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মিত হয়েছে। সেক্ষেত্রে নুরুল ইসলাম অত্যন্ত সৌভাগ্যবান। কারণ তার মাধ্যমে এই দ্বীনি কমপ্লেক্স হয়েছে। তিনি বলেন, এই মসজিদ ছাড়াও সারা দেশে মসজিদভিত্তিক ১২শ মক্তব পরিচালনা করে যমুনা গ্রুপ।