আমার বাবা আমাদের সবকিছু...
মনিকা ইসলাম
বাস্তবের একজন স্বপ্নদ্রষ্টা, সফল উদ্যোক্তা, একজন পথপ্রদর্শক, অফুরন্ত এক অনুপ্রেরণা, সত্যিকারের একজন সাহসী মানুষ এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা-তিনি আমার বাবা। নুরুল ইসলাম বাবুল।
বাস্তবের একজন স্বপ্নদ্রষ্টা, সফল উদ্যোক্তা, একজন পথপ্রদর্শক, অফুরন্ত এক অনুপ্রেরণা, সত্যিকারের একজন সাহসী মানুষ এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা-তিনি আমার বাবা। নুরুল ইসলাম বাবুল।
বাবা চলে যাওয়ার পর আমি তাকে নিয়ে কোনো কথা লিখতে পারিনি। লিখিনি। তিনি চলে গেছেন, সেটাই মানতে পারিনি। তাই লেখা হয়নি। বলা হয়নি অনেক কথা, অনেক কিছু। শুধুই বলেছি, আনমনে চোখের জলে। কিন্তু আজ? আজ তো এক বছর পূর্ণ হতে চলেছে। ভাবছি। ভাবনার অকূল পাথারে শুধু ছোপ ছোপ কান্না।
নীল কষ্টের শব্দ আছড়ে পড়ছে চারদিক। তবু অকৃত্রিম ভালোবাসার সেই আহ্বান এখনো বহমান। মনের দুয়ার খুলে আমাদের দু’হাত দোয়ায় উদগ্রীব সারাক্ষণ। চলে গেল ৩৬৫ দিন! কিন্তু কখন, কীভাবে গেছে বুঝিনি। বুঝেছি-বাবা ছিল, বাবা আছে, বাবা থাকবেন। কিন্তু বাবাকে নিয়ে কখনো এভাবে লিখতে হবে, তা ভাবিনি। তবু অনেক অব্যক্ত কষ্ট নিয়ে দুটি লাইন লেখার সাহস করলাম।
ছোটবেলা থেকেই আমি ওনার কাজের ভক্ত ছিলাম। কখন যেন আমিও হয়ে উঠেছিলাম তার কাজের প্রেরণার বড় উৎসাহ...। বাবা আমার সদালাপী। উদারতা ছিল অতুলনীয়। বাবা ছিলেন আমাদের আইডল। ওনার কাছে শিখেছি কীভাবে পরিশ্রম করে উপরে উঠতে হয়। যা ওনার শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ছিল। আমাদের ভাইবোনদের উনি সব সময় বোঝাতেন, আমরা যেন কোথাও কোনো অন্যায়ের সঙ্গে আপস না করি। তা সে যেই হাক। সত্য-মিথ্যা যেন আলাদা করতে শিখি। আল্লাহর ওপর ভরসা করে সব সময় সবকিছু সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করতে শিখিয়েছেন। আমরা তা শিখেছি এবং ধারণ করেছি।
আমাদের ভাইবোনদের শুধু নয়, উনি এ বিষয়গুলো যমুনার প্রত্যেক কর্মীকে বলতেন। শেখাতেন। বলতেন, শুধু স্বপ্ন দেখলে হবে না। স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য সেভাবে কাজও করতে হবে। জীবনকে স্বপ্নের চেয়ে বড় করে দেখতে হবে। এভাবে নিজের স্বপ্নকে গড়তে হবে।
তিনি আরও বেশি জোর দিতেন কমিটমেন্টের ওপর। বলতেন, সব সময় কমিটমেন্টের মর্যাদা দিতে শেখো। একজন সফল মানুষ এবং সার্থক উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য এটা খুবই জরুরি। তিনি সব সময় বর্তমান-ভবিষ্যতের সমন্বয় ঘটিয়ে চিন্তা করতেন। ছিলেন বড় ইন্টিলিজেন্স। দূরদর্শী। সবকিছুতে অনেক দূর দেখতে পেতেন। কোনো কিছুর ভালোটা ভাবার আগে তার নেগেটিভ দিক পর্যালোচনা করে নিতেন। পুরোদস্তুর গোছানো মানুষ।
ভাবতেন দেশ, দেশের মানুষ, দেশের অর্থনীতির ভবিষ্যৎ এবং অন্যান্য উন্নত দেশের পদ্ধতি ও কৌশল নিয়ে। কীভাবে উন্নত দেশের চেয়ে ভালো ফর্মুলা বের করে দেশকে উন্নতির শিখরে নেওয়া যায়। তার নির্জলা দর্শন দিতেন। ওনার অপ্রকাশিত বাস্তব অর্থনীতির অনেক ফর্মুলা নিয়ে ভবিষ্যতে গবেষণাও হতে পারে।
এছাড়া উনি শুধু ভাবতেন না, উনি করে দেখাতেন। আবার সেটি হতে হবে এক নম্বর। আবার এতকিছু করার পরও উনি থেমে থাকতে চাননি। আরও অনেক স্বপ্নের বীজ উনি বুনে গেছেন। যা আমরা বাবার আদর্শে সামনে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি।
আমি এখনো বিশ্বাস করি না, উনি নেই। বিশ্বাস এতটুকু-‘রুহ’র মৃত্যু নেই। মৃত্যু শুধু শরীরের। আমরা সবাই ট্রাভেলার বা যাত্রী, আর এই পৃথিবী একটা স্টেশন। বাবা এখন এই স্টেশন থেকে আর এক স্টেশনে আছেন, এটা সময়ের ব্যবধান মাত্র। একদিন আমরাও যাব। আবারও দেখা হবে, কথা হবে, আব্বা, আম্মা একসঙ্গে গল্প করব। এই পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাওয়া সেই বাবাকে নিয়ে। জানি না ধর্মীয়ভাবে এমন চিন্তা কতখানি সঠিক। তবু আমার, আমাদের ভাবনায় বাবাকে নিয়ে এমন চিন্তা মানসিক শক্তি জোগায়।
প্রতিদিন দুপুরে খাবার টেবিলে, অফিস রুমে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যবসা নিয়ে, রাজনীতি নিয়ে কত কথা, কত শত বিষয় নিয়ে আমাদের সেই সরগরম আলোচনা। যা ছিল টিভি টকশো থেকেও প্রাণবন্ত, তথ্যসমৃদ্ধ। আবার মধুর বিতর্কও হতো। যুক্তি ও তথ্য থাকলে বাবা অনেক সময় আমাদের যুক্তিও মেনে নিতেন। এগুলো ছিল আমাদের পরম পাওয়া।
আমরা ভাবি। ভাবতে ভালো লাগে। এমন সব আবারও হবে? হয়তো হবে। হবে না, বলতে চাই না। এই পৃথিবীর বাইরে আর এক অসীমে। যার শুরু আছে, শেষ নেই।
বারবার মনে হয়, বাবা যদি আর একটু থাকতেন। আরও কিছুদিন...। আর একটু যদি কাছে পেতাম। অফিসে ওনার রুমে দুই ঘণ্টা মিটিং করে আসার কিছুক্ষণ পরে যেভাবে আবারও ফোন দিয়ে বলতেন-‘আম্মু কী খবর? আসো আমার রুমে’ আবারো যদি বলতেন! সত্যি বলতে কী আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, বাবা ডাকছেন। ফোন বেজে উঠেছে। কিন্তু যখন বুঝতে পারি। নাহ! এটা আমার মতিভ্রম। বাবা তো আর আসবেন না, ডাকবেন না আর কোনোদিন ওই ডাকে। ততক্ষণে চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে টেবিলে।
তবু সব সময় মনে মনে ভেবে নিই, ডাকছেন বাবা। ডাকছেন আমাদের। তাই আজও আমরা যা-ই কিছু করি, ওনার দেখানো নির্দেশনাতেই করি এবং করে যাব। আমার কাছে, আমার ভাইবোনদের কাছে, বাবা নেই এটা কখনো ফিল হয় না। বরং এটাই সব সময় মনে হয়, উনি আছেন আমাদের চারদিক ঘিরে। আমাদের প্রতিটা কাজের মধ্যে উনি আছেন। সত্য কথা বলতে কী-অন্তত আগামী ২০ বছরের রূপরেখা রোডম্যাপ উনি আমাদের দিয়ে গেছেন। ওনার রেখে যাওয়া সমাপ্ত ও অসমাপ্ত প্রকল্পগুলো, ইচ্ছাগুলো কীভাবে পরিচালিত হবে তার সবকিছুই আমরা শুধু বাস্তবায়ন করছি মাত্র। আল্লাহর রহমতে সবই হচ্ছে ওনার মতো করে। যেমনটি উনি চেয়েছেন। হয়তো এতটুকু আমাদের সান্ত্বনা খোঁজার জায়গা।
অবশ্য এখন বুঝতে পারছি, বাবা কেন সবকিছু এত তাড়াতাড়ি করতে চাইছিলেন। আর কেন একই বিষয় বারবার বোঝাতেন। হয়তো উনি বুঝতে পারছিলেন কিছু। বুঝেও হয়তো বলেননি। তাই উনি চাইছিলেন, যেন তার অবর্তমানেও তার স্বপ্নকে আমরা ধরে রাখতে পারি। তাই ধৈর্য ও মনোযোগ দিয়ে সবকিছু নিখুঁতভাবে শিখিয়েছেন। এক একটা জিনিস বারবার করে বলতেন। বুঝতেন পরিবার কতটা গুরুত্বপূর্ণ। সবাইকে উনি এক ছাদের নিচে থেকে এক হয়ে কাজ করতে বলতেন। এই করোনা মহামারিতেও রোজ অফিসে যেতেন। মানা করলে বলতেন, এতগুলো মানুষের বেতন আছে; আমি প্রতিষ্ঠান না চালালে ওদের কী হবে? ওরা কীভাবে বাঁচবে? রিজিকের মালিক আল্লাহ। তবু আমার চেষ্টা তো থাকতে হবে।
ওনার সঙ্গে আমার শেষ কথা ফোনকলে হয়েছিল ৪ মিনিট। তখন বাবা হাসপাতালে। ওই ৪ মিনিটের ৩ মিনিটই ছিল ‘সবার স্যালারি দিয়েছ তো? লকডাউনে সব এমপ্লয়িরা বিপদে পড়বে।’ আর কীভাবে কী করতে হবে... এসব। আর ১ মিনিট হয়েছিল ওনার শরীর কেমন আছে তা নিয়ে। ভাবা যায়? এই ছিল আমার বাবা। আমাদের বাবা। যা বাইরে থেকে কারও বোঝার কথা নয়।
আমার বড় দুঃখ থেকে যাবে আজীবন। কেন তাকে অফিসে যেতে বাধা দিলাম না। আর একটু জোর করলাম না কেন? হয়তো একটু রাগ করে বললে উনি যেতেন না। হয়তো করোনা তাকে ছুঁতে পারত না। অবশ্য এসব হয়তো নিজের জন্য সান্ত্বনা। কিন্তু মহান আল্লাহ তার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছেন। জীবন-মৃত্যু সবই তো তার হাতে। হয়তো এর মধ্যে আল্লাহ তার জন্য পরকালে ভালো কিছু রেখেছেন। আমি, আমরা সেটাই বিশ্বাস করি। আর সন্তান হিসেবে আমরা তার জন্য দোয়া করছি এবং আজীবন করেই যাব।
শেষকথা, আমরা পৃথিবীতে মুসাফির মাত্র। ক্ষণিকের জন্য এসেছি। একদিন সবাই চলে যাব। তবে কিছু মানুষ চলে গেলে তাদের অবদান, তাদের স্বপ্ন অনেক গভীরভাবে রেখে যায় তার প্রিয় মানুষের মাঝে। তাই আজ হয়তো তিনি সশরীরে নেই। তবে আছেন আমাদের মনে, আমাদের চিন্তাধারায় এবং আমাদের কাজের মধ্যে। আমার বিশ্বাস, রেখে যাওয়া তার কাজের মধ্যেই বেঁচে থাকবেন আমাদের বাবা। এটাই আমার বাবার জীবনে বড় সাফল্য।