দেশ এক স্বপ্নদ্রষ্টা শিল্পোদ্যোক্তাকে হারিয়েছে
দেশবরেণ্য শিল্পপতি, যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান ও বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলামের মৃত্যুতে সর্বত্র শোকের ছায়া নেমে এসেছে। দেশের কবি-সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী ও নারী নেতৃবৃন্দ শোক প্রকাশ করেছেন। বিবৃতিতে তারা বলেন, যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান সব সময় দেশের মানুষের কথা ভাবতেন। দেশের শিল্প উন্নয়নে তার বিশাল ভূমিকা রয়েছে, বিশেষ করে তার মেধা, দক্ষতা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ও মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে আধুনিক চিন্তার সাহসী উদ্যোক্তা ছিলেন। শত পরিশ্রম করে গড়ে তোলেন অসংখ্য শিল্পপ্রতিষ্ঠান। সেখানে হাজার হাজার লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। তিনি দেশের অর্থনীতির একজন নক্ষত্র ছিলেন। তার মৃত্যুতে দেশ একজন স্বপ্নদ্রষ্টা শিল্পোদ্যোক্তাকে হারিয়েছে........
লেখকদের তিনি সম্মান করতেন
সৈয়দ আবুল মকসুদ, লেখক, বুদ্ধিজীবী
দেশীয় শিল্প-উদ্যোক্তাদের আমি শ্রদ্ধার চোখে দেখি। জনবলে শিক্ষিত বেকারের দেশে কর্মসংস্থান দরকার। যমুনা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও কর্ণধার জনাব নুরুল ইসলাম বাবুলকে আমি ’৭২ সাল থেকে চিনি, তবে ঘনিষ্ঠতা ছিল না। যুগান্তর পত্রিকা প্রকাশের পর পত্রিকার অনুষ্ঠানগুলোতে তাকে কাছ থেকে দেখি। লেখকদের তিনি সম্মান করতেন।
অতি পরিশ্রমী মানুষ ছিলেন। বাংলাদেশের আধুনিক বেসরকারি খাতের বিকাশে তার ভূমিকা অসামান্য। তার প্রতিষ্ঠানগুলোর উৎপাদিত পণ্য খুবই জনপ্রিয়। লক্ষ্য করেছি, তিনি সব পণ্য ও প্রতিষ্ঠান সর্বোচ্চ মানের করতে চাইতেন। তার মৃত্যুতে একটা শূন্যতা সৃষ্ট হল।
তার একটা প্রধান গুণ ছিল, তিনি ঋণখেলাপি ছিলেন না। আমি তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি।
হাইকেল হাশমী, লেখক, ব্যাংকার
এটা ১৯৮২ সালের কথা, আমি কেবলমাত্র অনার্স পরীক্ষা দিয়ে আমদানি-রফতানি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ শুরু করেছি। ওই ভবনের তিন এবং চারতলায় সদ্যপ্রয়াত জনাব নুরুল ইসলাম বাবুলের অফিস ছিল। শুনতাম তিনি কড়া এবং রাগী মানুষ, আমার সঙ্গে কোনো দিন সরাসরি দেখা হয়নি। কিন্তু ওই সময় আমি তার মানবিক গুণ দেখেছি। আমাদের অফিসে একজন পিয়ন ছিল, যাকে আমার মালিক কোনো কারণে এক ঘণ্টার নোটিশে বের করে দিল, তার যাওয়ার কোনো জায়গা ছিল না, সে রাতের বেলায় এই অফিসে থাকত। সে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কাঁদছিল, তখন নুরুল ইসলাম সাহেব সিঁড়ি দিয়ে তার অফিসে যাওয়ার জন্য উঠছিলেন।
ওই ছেলের কাছে কান্নার কারণ জানতে চাইলেন এবং শোনার পর সঙ্গে সঙ্গে নিজের প্রতিষ্ঠানে চাকরি দিয়ে দিলেন। ব্যাংকে চাকরির সুবাদে তার সম্বন্ধে অনেক কথাই শুনেছি কিন্তু তিনি প্রকৃতপক্ষে একজন মানবিক লোক ছিলেন এটা আমার বিশ্বাস।
এই গুণ না থাকলে এত লোকের চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করা, ব্যবসা প্রসার করা অসম্ভব হতো। দেশ একজন যোগ্য সন্তান হারিয়েছে। আল্লাহ তার রুহের মাগফেরাত করুন আর বেহেশত দান করুন, আমিন!
যমুনা গ্রুপ বাংলাদেশের উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে
আবুল কাসেম ফজলুল হক, অধ্যাপক, বুদ্ধিজীবী
স্বাধীনতাপরবর্তী দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা এতটা শক্তিশালী ছিল না। সেই সময় যুবক নুরুল ইসলাম বাবুল যমুনা গ্রুপ নামে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। তার একান্ত প্রচেষ্টায় যমুনা গ্রুপ আজ দেশের অন্যতম প্রধান শিল্পপ্রতিষ্ঠান, যা বাংলাদেশের উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রেখে চলেছে। তৈরি করেছে হাজারও মানুষের কর্মসংস্থান। যুগান্তর পত্রিকা ও যমুনা টেলিভিশনের মাধ্যমে নুরুল ইসলাম বাবুল সাহেব বাংলাদেশের মিডিয়ায় রেখেছেন যুগান্তকারী ভূমিকা। তার মিডিয়া প্রতিষ্ঠান দলকানা হয়নি। স্বাধীনভাবে তুলে ধরেছে গণমানুষের কথা। বজায় রেখেছে নিরপেক্ষতা।
নুরুল ইসলাম বাবুলের গড়ে তোলা যমুনা ফিউচার পার্ক দক্ষিণ এশিয়ার বৃহৎ একটি মার্কেট, যা বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করেছে। অসময়ে তার মৃত্যুতে আমি গভীর শোক প্রকাশ করছি।
মানুষের হৃদয়ে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন
রোকেয়া কবীর, সংগঠক
যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম একজন সফল শিল্প উদ্যোক্তা ছিলেন। তিনি শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে লাখো মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন। দৈনিক যুগান্তর ও যমুনা টেলিভিশনের মাধ্যমে একঝাঁক সাহসী সাংবাদিক তৈরি করেছেন। দেশকে অগ্রগতির দিকে নিয়ে যেতে ইতিবাচক ধারণা পত্রিকায় প্রকাশ ও টেলিভিশনে প্রচারের ব্যবস্থা করেছেন তিনি। মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম তার কাজের জন্যই দেশের মানুষের হৃদয়ে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
অনেক বড় মনের মানুষ ছিলেন
রাশেদা কে চৌধুরী, শিক্ষাবিদ
যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম বাবুলকে অনেকভাবেই চিনি। তিনি একজন বিশাল মাপের শিল্প উদ্যোক্তা। তার বড় বড় প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে কমবেশি সবাই অবিহিত। মিডিয়া থেকে শুরু করে প্রক্রিয়াজাতকরণ অনেক প্রতিষ্ঠান তার রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে তিনি অনেক মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন। আমি উনাকে (নুরুল ইসলাম) ব্যক্তিগতভাবে চিনি ’৮০-এর দশক থেকে। সে সময় তিনি বনানীতে যে বাড়িতে থাকতেন, আমি তার প্রতিবেশী ছিলাম। সেন্ট জোসেফের ছাত্র আমার ছেলের সহপাঠী ছিল উনার ছেলে। আজকালকার অভিভাবকরা তাদের সন্তানেরা কার সঙ্গে পড়ছে সেই খবর রাখেন না। আমাদের ছেলেমেয়েরা যখন লেখাপড়া করত আমরা যোগাযোগ রাখতাম কার সঙ্গে তারা মিশছে। অভিভাবকদের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে উঠত। ’৮০-এর দশকে আমি উন্নয়ন কর্মী হিসেবে যোগ দিয়েছি। সে সময়ে দৈনিক যুগান্তরের প্রকাশক সালমা ভাবিকে দেখেছি সন্তান লালন-পালনের পাশাপাশি আইন পেশায় পড়াশোনা করছেন। এই সমর্থনটা তিনি নুরুল ইসলাম বাবুল ভাইয়ের কাছ থেকে পেয়েছেন। এই সাহস উনার কাছ থেকে না পেলে সালমা ভাবি পাবলিক ফিগার হয়ে উঠতে পারতেন না। এটাও আমাদের স্বীকার করা উচিত। আমরা অনেকেই নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলি। ক্ষমতায়নের শুরুটা যে ঘর থেকেই হতে হয় সেটা হয়তো অনেকেই বলেন না। তিনি বলেন, আমার কর্মজীবন শুরু করেছি উন্নয়ন কর্মী, গবেষক হিসেবে। এখনও একই পেশায় কর্মরত রয়েছি। একবার মহিলা সংগঠনগুলো পঙ্গু হাসপাতালের রোগীদের জন্য কয়েকটি বৈদ্যুতিক পাখা জোগাড় করার কথা ভাবছিলাম। নুরুল ইসলাম বাবুল ভাইয়ের কথা মনে হতেই তার বাড়ি চলে গেলাম। তিনি সব শুনে হেসে বললেন, ‘কয়টা লাগবে। সঙ্গে সঙ্গে এও বললেন, আর কিছু লাগবে?’ আমি বলেছিলাম, দু-তিনটা হুইল চেয়ার দিলে ভালো হয়। তিনি বলেছিলেন, আমরা তো হুইল চেয়ার তৈরি করি না। কিন্তু জোগাড় করে দিতে পারব। কোথায় দিতে হবে। নুরুল ইসলাম বাবুল ভাইয়ের কাছ থেকে পঙ্গু হাসপাতালের রোগীদের জন্য বৈদ্যুতিক পাখা ও হুইল চেয়ার জোগাড় করেছিলাম।
তার মৃত্যু সংবাদ অনেক কষ্টে মেনে নিতে হয়েছিল
হেলাল হাফিজ, কবি
স্বাধীনতাপরবর্তী বাংলাদেশের আজকের এই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে যে অল্প কয়জন শিল্প-উদ্যোক্তার বড় অবদান রয়েছে নুরুল ইসলাম তাদের অন্যতম।
তার যমুনা গ্রুপ দেশের বেকার সমস্যার সমাধানে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে।
যমুনা টেলিভিশন ও দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার মতো মানুষের আস্থা অর্জনকারী দুটো মিডিয়ারও তিনি প্রতিষ্ঠাতা। তারই একটি দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় আমার কাজ করার সুযোগ হয়েছিল। কাছ থেকে দেখা এই স্বপ্নবাজ মানুষটির মৃত্যুসংবাদ অনেক কষ্টে মেনে নিতে হয়েছিল।
গণমাধ্যমে বিনিয়োগ করেছেন
আরমা দত্ত এমপি
একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নুরুল ইসলাম বাবুলের প্রতি আমার হৃদয়ে বড় একটা শ্রদ্ধার জায়গা রয়েছে। তরুণ বয়সে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে তিনি দেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছেন। তার কাজের আরেকটি বড় ক্ষেত্র হল তিনি গণমাধ্যমে বিনিয়োগ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে লালন করে তিনি তা যুগান্তর পত্রিকা ও যমুনা টেলিভিশনের মাধ্যমে মানুষের মাঝে দৃঢ় করার কাজ করেন। নতুন প্রজন্মকে সাংবাদিক করে তোলা, তাদের গণমাধ্যমে যুক্ত করা- এটা তার এক বড় অবদান। শুধু তাই নয়, তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারকেও নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন।
দেশ হারাল এক স্বপ্নদ্রষ্টা শিল্পোদ্যোক্তাকে
ফারুক মঈনউদ্দীন, গল্পকার, ব্যাংকার
কোভিড ১৯ মহামারী আমাদের অনেক অপূরণীয় ক্ষতির মুখোমুখি করেছে। আমরা জানি ব্যবসার ক্ষতি হলে সেটা মিটিয়ে নেয়া যায়, বিনিয়োগ বা উৎপাদন ব্যাহত হলে সেটিকেও ধরে ফেলা যায়, কিন্তু একটি জীবনের বিনাশ ঘটলে সেই ক্ষতিপূরণ করা সম্ভব হয় না। ক্ষতিটা আরও বেশি অনুভূত হয় যখন দেশ হারায় তার একজন বড় শিল্পোদ্যোক্তাকে।
যমুনার গ্রুপের কর্ণধার নুরুল ইসলাম বাবুলের প্রয়াণে দেশ ও জাতি হারাল আর এক স্বপ্নদ্রষ্টা শিল্পোদ্যোক্তাকে। যার হাত ধরে এ দেশে অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। বিশেষ করে দুটি মিডিয়া প্রতিষ্ঠান- যুগান্তর এবং যমুনা টেলিভিশন তিনি প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। আমরা তার সব কীর্তির কথা স্মরণে রেখে প্রার্থনা করি পরলোকে তিনি যেন মহিমান্বিত থাকেন।
অসংখ্য মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে তার হাতে
রেজাউদ্দিন স্টালিন, কবি, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব
পৃথিবীতে কিছু কিছু মৃত্যু থাই পাহাড়ের মতো ভারি। সব মানুষের কাছে এক সাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম বাবুলের মৃত্যুও আমাদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জগতকে সেরকম শোকে ভারি করে দিয়েছে। তার স্বপ্নের দৈনিক যুগান্তর আজ আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত। কবি-সাহিত্যিকদের তিনি সম্মান দিতে জানতেন। তার রুচি আজ নান্দনিকতার শীর্ষে। অসংখ্য মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে তারই হাতে। সাংবাদিকতার পেশা যে স্বাধীন সেটা তিনি গভীরভাবে বুঝেছিলেন। সাইফুল আলমের মতো স্বাধীনচেতা ও সৎ সাংবাদিক তার যুগান্তরকে পেশাদারিত্বের জায়গায় নিয়ে যেতে পেরেছেন। এটা তার মনোভাবকেই প্রকাশ করে। আমরা তারুণ্যেই তাকে চিনেছি। তার মতিঝিলের অফিসে গেলে কখনও খালি মুখে ফেরাননি। জনবান্ধব, সদালাপি এই মানুষের প্রতি আমার অন্তরের শ্রদ্ধা। তিনি বেঁচে থাকবেন অসংখ্য মানুষের হৃদয়ে এবং তার কর্মে।
তার কাজের ধারাবাহিকতা আগামীতেও অব্যাহত থাকবে
সীমা মোসলেম, সংগঠক
নুরুল ইসলাম বাবুল একজন বড় মাপের শিল্প উদ্যোক্তা ছিলেন। দৈনিক যুগান্তর ও যমুনা টেলিভিশনের মাধ্যমে তিনি গণমাধ্যমেও ভূমিকা রেখেছেন। আশা করব, তার এই কাজের ধারাবাহিকতা আগামীতেও অব্যাহত থাকবে। তিনি বলেন, কোভিড-১৯ এর ভয়াবহতা কতটা মারাত্মক, সেক্ষেত্রে সচেতনতা এই সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য সার্বিক ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন কতটা জরুরি, এই গুণী ব্যক্তির মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আমরা তা অনুভব করলাম। তার চলে যাওয়া দেশের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি।
সৈয়দ আবুল মকসুদ, লেখক, বুদ্ধিজীবী
দেশীয় শিল্প-উদ্যোক্তাদের আমি শ্রদ্ধার চোখে দেখি। জনবলে শিক্ষিত বেকারের দেশে কর্মসংস্থান দরকার। যমুনা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও কর্ণধার জনাব নুরুল ইসলাম বাবুলকে আমি ’৭২ সাল থেকে চিনি, তবে ঘনিষ্ঠতা ছিল না। যুগান্তর পত্রিকা প্রকাশের পর পত্রিকার অনুষ্ঠানগুলোতে তাকে কাছ থেকে দেখি। লেখকদের তিনি সম্মান করতেন।
অতি পরিশ্রমী মানুষ ছিলেন। বাংলাদেশের আধুনিক বেসরকারি খাতের বিকাশে তার ভূমিকা অসামান্য। তার প্রতিষ্ঠানগুলোর উৎপাদিত পণ্য খুবই জনপ্রিয়। লক্ষ্য করেছি, তিনি সব পণ্য ও প্রতিষ্ঠান সর্বোচ্চ মানের করতে চাইতেন। তার মৃত্যুতে একটা শূন্যতা সৃষ্ট হল।
তার একটা প্রধান গুণ ছিল, তিনি ঋণখেলাপি ছিলেন না। আমি তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি।
দেশ একজন যোগ্য সন্তান হারিয়েছে
এটা ১৯৮২ সালের কথা, আমি কেবলমাত্র অনার্স পরীক্ষা দিয়ে আমদানি-রফতানি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ শুরু করেছি। ওই ভবনের তিন এবং চারতলায় সদ্যপ্রয়াত জনাব নুরুল ইসলাম বাবুলের অফিস ছিল। শুনতাম তিনি কড়া এবং রাগী মানুষ, আমার সঙ্গে কোনো দিন সরাসরি দেখা হয়নি। কিন্তু ওই সময় আমি তার মানবিক গুণ দেখেছি। আমাদের অফিসে একজন পিয়ন ছিল, যাকে আমার মালিক কোনো কারণে এক ঘণ্টার নোটিশে বের করে দিল, তার যাওয়ার কোনো জায়গা ছিল না, সে রাতের বেলায় এই অফিসে থাকত। সে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কাঁদছিল, তখন নুরুল ইসলাম সাহেব সিঁড়ি দিয়ে তার অফিসে যাওয়ার জন্য উঠছিলেন।
ওই ছেলের কাছে কান্নার কারণ জানতে চাইলেন এবং শোনার পর সঙ্গে সঙ্গে নিজের প্রতিষ্ঠানে চাকরি দিয়ে দিলেন। ব্যাংকে চাকরির সুবাদে তার সম্বন্ধে অনেক কথাই শুনেছি কিন্তু তিনি প্রকৃতপক্ষে একজন মানবিক লোক ছিলেন এটা আমার বিশ্বাস।
এই গুণ না থাকলে এত লোকের চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করা, ব্যবসা প্রসার করা অসম্ভব হতো। দেশ একজন যোগ্য সন্তান হারিয়েছে। আল্লাহ তার রুহের মাগফেরাত করুন আর বেহেশত দান করুন, আমিন!
যমুনা গ্রুপ বাংলাদেশের উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে
আবুল কাসেম ফজলুল হক, অধ্যাপক, বুদ্ধিজীবী
স্বাধীনতাপরবর্তী দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা এতটা শক্তিশালী ছিল না। সেই সময় যুবক নুরুল ইসলাম বাবুল যমুনা গ্রুপ নামে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। তার একান্ত প্রচেষ্টায় যমুনা গ্রুপ আজ দেশের অন্যতম প্রধান শিল্পপ্রতিষ্ঠান, যা বাংলাদেশের উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রেখে চলেছে। তৈরি করেছে হাজারও মানুষের কর্মসংস্থান। যুগান্তর পত্রিকা ও যমুনা টেলিভিশনের মাধ্যমে নুরুল ইসলাম বাবুল সাহেব বাংলাদেশের মিডিয়ায় রেখেছেন যুগান্তকারী ভূমিকা। তার মিডিয়া প্রতিষ্ঠান দলকানা হয়নি। স্বাধীনভাবে তুলে ধরেছে গণমানুষের কথা। বজায় রেখেছে নিরপেক্ষতা।
নুরুল ইসলাম বাবুলের গড়ে তোলা যমুনা ফিউচার পার্ক দক্ষিণ এশিয়ার বৃহৎ একটি মার্কেট, যা বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করেছে। অসময়ে তার মৃত্যুতে আমি গভীর শোক প্রকাশ করছি।
মানুষের হৃদয়ে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন
রোকেয়া কবীর, সংগঠক
যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম একজন সফল শিল্প উদ্যোক্তা ছিলেন। তিনি শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে লাখো মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন। দৈনিক যুগান্তর ও যমুনা টেলিভিশনের মাধ্যমে একঝাঁক সাহসী সাংবাদিক তৈরি করেছেন। দেশকে অগ্রগতির দিকে নিয়ে যেতে ইতিবাচক ধারণা পত্রিকায় প্রকাশ ও টেলিভিশনে প্রচারের ব্যবস্থা করেছেন তিনি। মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম তার কাজের জন্যই দেশের মানুষের হৃদয়ে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
অনেক বড় মনের মানুষ ছিলেন
রাশেদা কে চৌধুরী, শিক্ষাবিদ
যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম বাবুলকে অনেকভাবেই চিনি। তিনি একজন বিশাল মাপের শিল্প উদ্যোক্তা। তার বড় বড় প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে কমবেশি সবাই অবিহিত। মিডিয়া থেকে শুরু করে প্রক্রিয়াজাতকরণ অনেক প্রতিষ্ঠান তার রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে তিনি অনেক মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন। আমি উনাকে (নুরুল ইসলাম) ব্যক্তিগতভাবে চিনি ’৮০-এর দশক থেকে। সে সময় তিনি বনানীতে যে বাড়িতে থাকতেন, আমি তার প্রতিবেশী ছিলাম। সেন্ট জোসেফের ছাত্র আমার ছেলের সহপাঠী ছিল উনার ছেলে। আজকালকার অভিভাবকরা তাদের সন্তানেরা কার সঙ্গে পড়ছে সেই খবর রাখেন না। আমাদের ছেলেমেয়েরা যখন লেখাপড়া করত আমরা যোগাযোগ রাখতাম কার সঙ্গে তারা মিশছে। অভিভাবকদের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে উঠত। ’৮০-এর দশকে আমি উন্নয়ন কর্মী হিসেবে যোগ দিয়েছি। সে সময়ে দৈনিক যুগান্তরের প্রকাশক সালমা ভাবিকে দেখেছি সন্তান লালন-পালনের পাশাপাশি আইন পেশায় পড়াশোনা করছেন। এই সমর্থনটা তিনি নুরুল ইসলাম বাবুল ভাইয়ের কাছ থেকে পেয়েছেন। এই সাহস উনার কাছ থেকে না পেলে সালমা ভাবি পাবলিক ফিগার হয়ে উঠতে পারতেন না। এটাও আমাদের স্বীকার করা উচিত। আমরা অনেকেই নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলি। ক্ষমতায়নের শুরুটা যে ঘর থেকেই হতে হয় সেটা হয়তো অনেকেই বলেন না। তিনি বলেন, আমার কর্মজীবন শুরু করেছি উন্নয়ন কর্মী, গবেষক হিসেবে। এখনও একই পেশায় কর্মরত রয়েছি। একবার মহিলা সংগঠনগুলো পঙ্গু হাসপাতালের রোগীদের জন্য কয়েকটি বৈদ্যুতিক পাখা জোগাড় করার কথা ভাবছিলাম। নুরুল ইসলাম বাবুল ভাইয়ের কথা মনে হতেই তার বাড়ি চলে গেলাম। তিনি সব শুনে হেসে বললেন, ‘কয়টা লাগবে। সঙ্গে সঙ্গে এও বললেন, আর কিছু লাগবে?’ আমি বলেছিলাম, দু-তিনটা হুইল চেয়ার দিলে ভালো হয়। তিনি বলেছিলেন, আমরা তো হুইল চেয়ার তৈরি করি না। কিন্তু জোগাড় করে দিতে পারব। কোথায় দিতে হবে। নুরুল ইসলাম বাবুল ভাইয়ের কাছ থেকে পঙ্গু হাসপাতালের রোগীদের জন্য বৈদ্যুতিক পাখা ও হুইল চেয়ার জোগাড় করেছিলাম।
তার মৃত্যু সংবাদ অনেক কষ্টে মেনে নিতে হয়েছিল
হেলাল হাফিজ, কবি
স্বাধীনতাপরবর্তী বাংলাদেশের আজকের এই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে যে অল্প কয়জন শিল্প-উদ্যোক্তার বড় অবদান রয়েছে নুরুল ইসলাম তাদের অন্যতম।
তার যমুনা গ্রুপ দেশের বেকার সমস্যার সমাধানে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে।
যমুনা টেলিভিশন ও দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার মতো মানুষের আস্থা অর্জনকারী দুটো মিডিয়ারও তিনি প্রতিষ্ঠাতা। তারই একটি দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় আমার কাজ করার সুযোগ হয়েছিল। কাছ থেকে দেখা এই স্বপ্নবাজ মানুষটির মৃত্যুসংবাদ অনেক কষ্টে মেনে নিতে হয়েছিল।
গণমাধ্যমে বিনিয়োগ করেছেন
আরমা দত্ত এমপি
একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নুরুল ইসলাম বাবুলের প্রতি আমার হৃদয়ে বড় একটা শ্রদ্ধার জায়গা রয়েছে। তরুণ বয়সে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে তিনি দেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছেন। তার কাজের আরেকটি বড় ক্ষেত্র হল তিনি গণমাধ্যমে বিনিয়োগ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে লালন করে তিনি তা যুগান্তর পত্রিকা ও যমুনা টেলিভিশনের মাধ্যমে মানুষের মাঝে দৃঢ় করার কাজ করেন। নতুন প্রজন্মকে সাংবাদিক করে তোলা, তাদের গণমাধ্যমে যুক্ত করা- এটা তার এক বড় অবদান। শুধু তাই নয়, তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারকেও নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন।
দেশ হারাল এক স্বপ্নদ্রষ্টা শিল্পোদ্যোক্তাকে
ফারুক মঈনউদ্দীন, গল্পকার, ব্যাংকার
কোভিড ১৯ মহামারী আমাদের অনেক অপূরণীয় ক্ষতির মুখোমুখি করেছে। আমরা জানি ব্যবসার ক্ষতি হলে সেটা মিটিয়ে নেয়া যায়, বিনিয়োগ বা উৎপাদন ব্যাহত হলে সেটিকেও ধরে ফেলা যায়, কিন্তু একটি জীবনের বিনাশ ঘটলে সেই ক্ষতিপূরণ করা সম্ভব হয় না। ক্ষতিটা আরও বেশি অনুভূত হয় যখন দেশ হারায় তার একজন বড় শিল্পোদ্যোক্তাকে।
যমুনার গ্রুপের কর্ণধার নুরুল ইসলাম বাবুলের প্রয়াণে দেশ ও জাতি হারাল আর এক স্বপ্নদ্রষ্টা শিল্পোদ্যোক্তাকে। যার হাত ধরে এ দেশে অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। বিশেষ করে দুটি মিডিয়া প্রতিষ্ঠান- যুগান্তর এবং যমুনা টেলিভিশন তিনি প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। আমরা তার সব কীর্তির কথা স্মরণে রেখে প্রার্থনা করি পরলোকে তিনি যেন মহিমান্বিত থাকেন।
অসংখ্য মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে তার হাতে
রেজাউদ্দিন স্টালিন, কবি, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব
পৃথিবীতে কিছু কিছু মৃত্যু থাই পাহাড়ের মতো ভারি। সব মানুষের কাছে এক সাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম বাবুলের মৃত্যুও আমাদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জগতকে সেরকম শোকে ভারি করে দিয়েছে। তার স্বপ্নের দৈনিক যুগান্তর আজ আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত। কবি-সাহিত্যিকদের তিনি সম্মান দিতে জানতেন। তার রুচি আজ নান্দনিকতার শীর্ষে। অসংখ্য মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে তারই হাতে। সাংবাদিকতার পেশা যে স্বাধীন সেটা তিনি গভীরভাবে বুঝেছিলেন। সাইফুল আলমের মতো স্বাধীনচেতা ও সৎ সাংবাদিক তার যুগান্তরকে পেশাদারিত্বের জায়গায় নিয়ে যেতে পেরেছেন। এটা তার মনোভাবকেই প্রকাশ করে। আমরা তারুণ্যেই তাকে চিনেছি। তার মতিঝিলের অফিসে গেলে কখনও খালি মুখে ফেরাননি। জনবান্ধব, সদালাপি এই মানুষের প্রতি আমার অন্তরের শ্রদ্ধা। তিনি বেঁচে থাকবেন অসংখ্য মানুষের হৃদয়ে এবং তার কর্মে।
তার কাজের ধারাবাহিকতা আগামীতেও অব্যাহত থাকবে
সীমা মোসলেম, সংগঠক
নুরুল ইসলাম বাবুল একজন বড় মাপের শিল্প উদ্যোক্তা ছিলেন। দৈনিক যুগান্তর ও যমুনা টেলিভিশনের মাধ্যমে তিনি গণমাধ্যমেও ভূমিকা রেখেছেন। আশা করব, তার এই কাজের ধারাবাহিকতা আগামীতেও অব্যাহত থাকবে। তিনি বলেন, কোভিড-১৯ এর ভয়াবহতা কতটা মারাত্মক, সেক্ষেত্রে সচেতনতা এই সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য সার্বিক ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন কতটা জরুরি, এই গুণী ব্যক্তির মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আমরা তা অনুভব করলাম। তার চলে যাওয়া দেশের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি।