ধর্মের প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন নুরুল ইসলাম
আহনাফ আব্দুল কাদির
পৃথিবীতে সবাই আসে একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। সময় শেষে সবাইকে ফিরে যেতে হয় অনন্ত অসীম জীবনে। এ সুনির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সাহসের সঙ্গে যে মানুষ ও মানবতার জন্য নিরলস কাজ করে যায় সেই সফলতা লাভ করে দুনিয়া ও আখিরাতে।
পৃথিবীতে সবাই আসে একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। সময় শেষে সবাইকে ফিরে যেতে হয় অনন্ত অসীম জীবনে। এ সুনির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সাহসের সঙ্গে যে মানুষ ও মানবতার জন্য নিরলস কাজ করে যায় সেই সফলতা লাভ করে দুনিয়া ও আখিরাতে।
যমুনা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান মরহুম নুরুল ইসলাম ছিলেন দেশ ও মানবতার কল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ এক সাহসী পুরুষ। গত বছরের ১৩ জুলাই তিনি অনন্ত জীবনের পথে পাড়ি দিয়েছেন। স্বাধীনচেতা ধর্মপ্রিয় ব্যক্তি ছিলেন এ মহান মানুষ।
যুগান্তর ‘ইসলাম ও জীবন’ পাতার সাবেক সম্পাদক প্রয়াত হাফেজ আহমাদ উল্লাহ যুগান্তরের পাতায় তুলে ধরেছিলেন তার ধর্মপ্রেমের অনন্য নজির। তিনি অভিভূত হয়ে লিখেছিলেন, ‘নুরুল ইসলাম শব্দটির অর্থ ধর্মের আলো। মানুষের ভেতর জগতে এত ঐশী আলো লুকিয়ে থাকতে পারে আমি কোনো আলেম, কোনো সুফি বা কোনো পীর সাহেবকেও দেখিনি। তার সঙ্গে প্রথম কথা বলে আমার মনে হয়েছে, ধর্ম পোশাকে নয়, মানব মনে লুকানো জিনিস’।
পারিবারিক ঐতিহ্য তাকে যেমন ধর্মের পথে পরিচালিত করেছে, তেমনি তার স্ত্রী অ্যাডভোকেট সালমা ইসলামের অনুপ্রেরণাও ছিল উল্লেখ করার মতো। হাফেজ আহমাদ উল্লাহর কলাম থেকে জানা যায়, সালমা ইসলামের অনুরোধে তার দোয়া-কালাম শুদ্ধ কিনা তা শুনতে যান তিনি। আলাপচারিতার এক ফাঁকে তিনি মুচকি হেসে বলেন, ‘আল্লাহর কাছে কি আলাদা কোনো ভাষায় কথা বলতে হবে? আল্লাহ কি তার বান্দার মনের ভাষা বোঝে না? আমি যে তার কাছে ক্ষমা চাইতে যাব, এটা কি আল্লাহ বোঝে না?’
এসব ভাবনায় তার গভীর ধর্মবোধের পরিচয় পাওয়া যায়। লেবাসসর্বস্ব ধর্মের বদলে ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা ও আদর্শ লালন করতে বেশি ভালোবাসতেন তিনি। নীতি-নৈতিকতা, ভ্রাতৃত্ববোধ, পরোপকার ও মানবপ্রেমে আজীবন মজে ছিলেন তিনি। তাই দেশ ও মানুষের জন্য অবিশ্রান্ত পরিশ্রম করেছেন। কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে হাসি ফুটিয়েছেন লাখ লাখ মানুষের মুখে। আশার আলো জ্বালিয়েছেন হাজার হাজার পরিবারের চোখে।
হজরত জারির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, যে ব্যক্তি মানুষের প্রতি অনুগ্রহ করে না আল্লাহতায়ালা তার প্রতি অনুগ্রহ করেন না (সহিহ বুখারি-৬০১৩)।
নুরুল ইসলাম সব সময় মানুষের প্রতি দয়াশীল ছিলেন। তাই আল্লাহ পাক তার প্রতি দুনিয়ায় দয়া করে বিশাল নিয়ামত ভান্ডারের মালিক বানিয়ে দিয়েছিলেন। নিশ্চয় আল্লাহ তার প্রিয় এ বান্দাকে পরকালেও নিয়ামরাজি দিয়ে ধন্য করবেন।
আল্লাহর প্রতি ছিল তার অগাধ বিশ্বাস ও ভক্তি। আলেম-ওলামাদের প্রতি ছিল অন্তরের অকৃত্রিম দরদ ও ভালোবাসা। হাফেজ্জী হুজুরসহ দেশের শীর্ষস্থানীয় আলেমদের সঙ্গে ছিল গভীর সম্পর্ক। আলেমদের তিনি গোপনে বিভিন্ন সময় মোটা অঙ্কের হাদিয়া-তোহফা দিতেন। তাদের সঙ্গে ইসলামের বিভিন্ন বিষয় ও ব্যবসা-বাণিজ্যের বিধিবিধান নিয়েও আলোচনা করতেন।
জীবন চলার পথে বারবার হোঁচট খেয়েছেন। তবু আশা ছাড়েননি। তার স্ত্রী দৈনিক যুগান্তরের প্রকাশক অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম স্মৃতিচারণ করে লেখেন, ‘চোখের সামনে শতকোটি টাকার ফ্যাক্টরি অগ্নিকাণ্ডে দাউ দাউ করে পুড়তে দেখেছেন। কিন্তু হতাশ হননি। আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে বলেছেন, বিপদ আল্লাহ দিয়েছেন, আবার তিনিই এর চেয়ে ভালো কিছু দান করবেন’। সত্যিই আল্লাহ তাকে দিয়েছেন। আল্লাহর প্রতি এমন অগাধ আস্থা ও বিশ্বাসের ফলেই তিনি অর্জন করেছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পপতির আসন।
ব্যবসার ক্ষেত্রে তিনি সততা ও আমানতদারিতা রক্ষা করে চলতেন। তার ঘনিষ্ঠজন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মো. জিয়াউল হক স্মৃতিচারণ করে লেখেন, ‘একদিন দুপুরে তার সঙ্গে গল্প করছি। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, সবাই ব্যাংকের মালিক হচ্ছে আপনি কেন নন?
তিনি দৃঢ়ভাবে উত্তর দিলেন, ‘আমি সুদের ব্যবসা করি না, করব না। আমার ছেলেমেয়েদের আমি সুদের টাকা দিয়ে খাওয়াব না’। শেয়ারবাজার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি চাইলে শত শত কোটি টাকা তুলে নিতে পারতাম; কিন্তু আমি কোনোদিনও শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করিনি। মানুষের কষ্টের অর্থ আত্মসাৎ করার মতো ঘৃণ্য কাজ আমি করব না’।
দায়িত্ব সচেতন এ মানুষটি সবার আগে অফিসে আসতেন, যেতেন সবার পরে। ছিলেন শ্রমিকবান্ধব। শ্রমিকদের দুঃখ-কষ্ট গভীরভাবে উপলব্ধি করতেন। নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্যের ব্যাপারে ছিলেন সজাগ-সচেতন। তার মেয়ে মনিকা ইসলামের স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, গত বছর করোনার সময়েও তিনি অফিসে যেতেন নির্দ্বিধায়। পরিবার থেকে বারণ করা হলেও শুনতেন না সেসব। এমনকি করোনাক্রান্ত হয়েও জীবনের শেষ দিনগুলোতে হাসপাতালে শুয়ে শ্রমিকদের বেতন-ভাতার খোঁজখবর নিয়েছেন।
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি যেমন নীতিবান ছিলেন, তেমনি পরিবার ও পরিচিতিজনদের ন্যায়-নীতির ওপর অটল থাকার সবক দিতেন। এ সবকিছু সম্ভব হয়েছে আল্লাহর প্রতি তার অগাধ আস্থা ও বিশ্বাসের ফলেই।
১৩ জুলাই তার মৃত্যুর এক বছর পূর্ণ হয়েছে। আল্লাহর কাছে চোখ ভেজা কাতর কণ্ঠে মোনাজাত করি, হে আল্লাহ! এই মহান মানুষকে আপনি জান্নাতুল ফেরদৌসের মেহমান হিসাবে কবুল করুন। আমিন।
লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট
akpatwary.qp@gmail.com