Loader
শিক্ষা, শান্তি, সেবা ও সামাজিক উন্নয়নই নুরুল ইসলাম ফাউন্ডেশন-এরমূল লক্ষ্য। পারস্পরিক সহযোগিতা, সহমর্মিতা, ভ্রাতৃত্ববোধ ও পরোপকার-এর মাধ্যমে বিশ্বমানবতার কল্যাণই আমাদের একমাত্র ব্রত। আর্তমানবতার সেবা, সমাজ সংস্কার, কর্মসংস্থান তৈরি, শিক্ষা উপকরণ বিতরণ, দারিদ্র্য বিমোচন, এতিম, গরিব, বয়স্ক, বিধবা ও প্রতিবন্ধীদের ভরণপোষণ, ছিন্নমূল ও পথবাসীদের পুনর্বাসন, ত্রাণ বিতরণ, স্বাস্থ্যসেবা প্রদানসহ সব শ্রেণির নাগরিকদের নৈতিক ও চারিত্রিক উন্নয়নের মাধ্যমে একটি সমৃদ্ধ ও স্বনির্ভর দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখি আমরা।

হাফেজ্জী হুজুরের ছেলে হাফেজ আতাউল্লাহর স্মৃতিতে নুরুল ইসলাম


তানজিল আমির

যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম ছিলেন একজন অনন্য এবং অসাধারণ শিল্পোদ্যোক্তা। তিনি ছিলেন বড় মনের মানুষ। সুদূরপ্রসারি চিন্তা করতে পারতেন। সে কারণে তার প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়ে দেশ স্বাধীন করেছেন, একইভাবে দেশের অর্থনীতি পুনর্গঠনেও যুদ্ধ করেছেন। মূলত স্বাধীনতা যুদ্ধ থেকেই প্রেরণা নিয়ে উদ্যোক্তা হওয়ার যুদ্ধে অবতীর্ণ হন তিনি।
বাঙালি মুসলমান হিসেবে মরহুম নুরুল ইসলাম স্বভাবজাতই ধারণ করতেন ইসলামের শাশ্বত চেতনা মনে। পবিত্র ধর্ম ইসলামের উদার ও কর্মমুখী প্রেরণা তাকে উজ্জীবিত করেছিল। যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান মরহুম নুরুল ইসলাম তার ব্যবসা-বাণিজ্যে নৈতিকতা ও দেশপ্রেমের বিষয়টিকে খুবই গুরুত্ব দিয়েছিলেন।
যুগান্তরের ইসলাম ও জীবন পাতার সম্পাদক হাফেজ আহমাদ উল্লাহ বলেন, তিনি সাধারণভাবে আলেম সমাজকে খুব ভালোবাসতেন। মাঝে মধ্যেই তিনি তার মাধ্যমে আলেমদের সমস্যা হলে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতেন। হাফেজ্জী হুজুরের একটা বড় অনুষ্ঠানের সময় তিনি একটি বড় অঙ্কের অর্থ অনুদান দিয়েছিলেন।
বিষয়টি জানতে চাই হাফেজ্জী হুজুরের একমাত্র জীবিত সন্তান খেলাফত আন্দোলনের আমির হাফেজ আতাউল্লাহর কাছে। বয়োবৃদ্ধ এ আলেম যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলামের কথা শুনেই আবেগাল্পুত হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, ‘আমরা তার রুহের মাগফিরাতের জন্য দোয়া করেছি। তার সদকায়ে জারিয়ার জন্য যা কিছু প্রয়োজন হয় আমরা করব।’
হাফেজ্জী হুজুর সংক্রান্ত একটি বড় অনুষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন মরহুম নুরুল ইসলাম। বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে কথা বলেছি হাফেজ্জী হুজুরের হয়ে কূটনৈতিক অঙ্গনে কাজ করা ব্যাংকার কাজী আজিজুল হকের সঙ্গে।
তিনি জানালেন, ঘটনাটি ছিল হাফেজ্জী হুজুরের স্মারকগ্রন্থ প্রকাশের সময়ের। ২০০২ সালের দিকে হুজুরের মেজ ছেলে মরহুম হাফেজ হামিদ উল্লাহর তত্ত্বাবধানে স্মারকগ্রন্থটি প্রকাশের সময় তারা যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যানের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন।

বিষয়টি অত্যন্ত আগ্রহ ও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেছিলেন মরহুম নুরুল ইসলাম। স্মারক প্রকাশে সহায়তার পাশাপাশি অনুষ্ঠানের সময় তিনি একটি বড় অঙ্কের অর্থ অনুদান দিয়েছিলেন। এ ছাড়া তার প্রতিষ্ঠিত দৈনিক যুগান্তরের মাধ্যমে অনুষ্ঠানটির সর্বোচ্চ প্রচারণায় সহায়তা করেছিলেন।
এতে হাফেজ্জী হুজুরের ছেলেরা আপ্লুত হয়ে তার জন্য বিশেষ দোয়া করেছেন এবং বলেছেন- এ মানুষটিকে দেখে বোঝা যেত না যে, তিনি আলেম সমাজকে এত ভালোবাসতেন।
হাফেজ আহমাদ উল্লাহ বলেন, ‘তিনি মাঝে মধ্যেই আলেম সমাজকে আমার মাধ্যমে সেনাকল্যাণে তার অফিসে ডেকে পাঠাতেন। এবং কোন ব্যবসা করা যায়, কোন ব্যবসা করা যাবে না- এমন খুঁটিনাটি বিষয় জেনে নিতেন। আলেমদের সঙ্গে বাহাস করা ছিল তার অভ্যাস।

আলেমরা অনেক সময় তার যুক্তির কাছে হেরে যেতেন। তখন তারা বলতেন, তিনি যা বলেন সোজাসাপটা বলেন। তার কথায় কোনো ঘোরপ্যাঁচ নেই। কিন্তু তার বাইরের সুরত দেখে বোঝা যায় না তিনি আল্লাহর প্রতি এতটা অগাধ বিশ্বাসী।’
এ বিষয়ে খেলাফত আন্দোলনের আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক কাজী আজিজুল হক শোনালেন তার একটি স্মৃতিকথা। মরহুম নুরুল ইসলামের অমর কীর্তির অন্যতম একটি বিষয় ছিল- বাংলাদেশে তিনি সর্বপ্রথম ‘হালাল সাবান’ উৎপাদন করেছেন। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হালাল প্রক্রিয়া অনুসরণে এ্যারোমেটিক সাবান বেশ জনপ্রিয় ছিল দেশে।
কাজী আজিজুল হক বলেন, একদিন এক সাক্ষাতে বিষয়টির তারিফ করে আমি তাকে বলি আপনি তো ইসলামকে খুব ভালোবাসেন। এ দেশের মুসলমানদের জন্য আপনি হালাল সাবান তৈরি করেছেন। এ কথা শুনে তৎক্ষণাৎ নুরুল ইসলাম বললেন, ‘ইসলামিক প্রেরণা থেকে আমি এটা করছি আপনারে কে বলল’?
এরপর তিনি বলেন, ঘটনা হল- আমি একটা কাজে লন্ডন গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে জানতে পারলাম উন্নত দেশগুলোয় হালাল-হারাম দু’ধরনের সাবান রয়েছে। মালয়েশিয়াভিত্তিক একটি ইসলামিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধানে হালাল সাবান মুসলিমরা ব্যবহার করেন।
কারণ অমুসলিম কোম্পানিগুলোর তৈরি সাবানে শূকরের চর্বি ব্যবহারের কথা শোনা যায়। সেখান থেকে আমি ভাবলাম, বাংলাদেশে তো অধিকাংশ মানুষ মুসলিম, হালাল প্রক্রিয়ায় সাবান উৎপাদনের বিষয়টি এখানে কাজে লাগানো যেতে পারে।
সেদিনকার কথার স্মৃতিচারণ করে কাজী আজিজুল হক বলেন, মরহুম নুরুল ইসলাম মানুষ হিসেবে স্বচ্ছ ছিলেন। তিনি যা বলতেন একবারে সোজাসাপটা বলতেন। তার তো সুযোগ ছিল এখানে ধর্মীয় আবেগ ব্যবহার করে আলেমদের সহানুভূতি অর্জনের। কিন্তু মনের আসল কথাটি অকপটে বলার সৎ সাহস তার ছিল। বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের জন্য ধর্মীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েই তিনি এমন ব্যবসায় নেমেছিলেন, কিন্তু শুরুটা যে তিনি শুধু ইসলামের জন্য করেছেন এমন কথা বলে সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের চিন্তা করেননি।
হাফেজ্জী হুজুরের ছেলেদের অফিসে আনার জন্য মরহুম নুরুল ইসলাম একবার নিজের ব্যবহৃত গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তা ছাড়া যখনই তার অফিসে আলেমরা আসতেন, একটি অভিজাত হোটেল থেকে বিশেষ খাবার এনে তাদের আপ্যায়ন করতেন।
মরহুম নুরুল ইসলাম প্রতিষ্ঠিত দৈনিক যুগান্তরই এ দেশের আলেম লেখকদের সর্বোচ্চ পৃষ্ঠপোষকতা করে আসছে। শূন্য দশকের গোড়ায় সংবাদ পরিবেশনার বৈচিত্র্যের সঙ্গে পত্রিকার জগতে ভিন্ন মাত্রা যোগ করে সপ্তাহে দু’দিন চার রঙে ছাপা ‘ইসলাম ও জীবন’ পাতা প্রকাশ করে যুগান্তর।

সংবাদপত্রের জগতে যা এক ইতিহাস। এ পাতা ও সৃজনশীলতার কারণে যুগান্তর সে সময় চলে যায় পাঠক প্রিয়তার শীর্ষে। সাধারণ পাঠকের পাশাপাশি যুগান্তরের ‘ইসলাম ও জীবন’ পাতা দেশের শীর্ষ আলেমদেরও ভালোবাসা অর্জন করে। ইসলামকে যুগোপযোগী ও আধুনিক ধর্ম হিসেবে বাংলাভাষীদের কাছে উপস্থাপনে ‘ইসলাম ও জীবন পাতা’ এখনও অন্যদের চেয়ে এগিয়ে।

তরুণ আলেমদের যোগ্য হিসেবে গড়ে তুলতে এ পাতাটি সবচেয়ে বেশি অবদান রাখছে। যুগান্তরের এ স্বতন্ত্র অবস্থান লাখো পাঠকের হৃদয়ে আলাদা একটি জায়গা করে নিয়েছে। যতদিন যুগান্তর থাকবে নুরুল ইসলামের এ ইসলামী পাতাটির অসংখ্য পাঠক তার জন্য দোয়া করবে। আল্লাহ যেন তাকে জান্নাত নসিব করেন।
লেখক : তরুণ আলেম ও সাংবাদিক