Loader
শিক্ষা, শান্তি, সেবা ও সামাজিক উন্নয়নই নুরুল ইসলাম ফাউন্ডেশন-এরমূল লক্ষ্য। পারস্পরিক সহযোগিতা, সহমর্মিতা, ভ্রাতৃত্ববোধ ও পরোপকার-এর মাধ্যমে বিশ্বমানবতার কল্যাণই আমাদের একমাত্র ব্রত। আর্তমানবতার সেবা, সমাজ সংস্কার, কর্মসংস্থান তৈরি, শিক্ষা উপকরণ বিতরণ, দারিদ্র্য বিমোচন, এতিম, গরিব, বয়স্ক, বিধবা ও প্রতিবন্ধীদের ভরণপোষণ, ছিন্নমূল ও পথবাসীদের পুনর্বাসন, ত্রাণ বিতরণ, স্বাস্থ্যসেবা প্রদানসহ সব শ্রেণির নাগরিকদের নৈতিক ও চারিত্রিক উন্নয়নের মাধ্যমে একটি সমৃদ্ধ ও স্বনির্ভর দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখি আমরা।

নুরুল ইসলাম মানে ধর্মের আলো


আহমাদ উল্লাহ

নুরুল ইসলাম। শব্দটির অর্থ ধর্মের আলো। মানুষের ভেতর জগতে এত ঐশী আলো লুকিয়ে থাকতে পারে আমি কোনো আলেম, কোনো সুফি বা কোনো পীর সাহেবকেও দেখিনি।
যুগান্তর পত্রিকার শুরুর দিকে যখন সালমা আপা তার বড় মেয়ের বিয়ের সময় আমাকে নুরুল ইসলাম বাবুল সাহেবের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন তখন এই বড় মানুষটি আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন। এত বড় একজন মানুষ যখন আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন আমি হকচকিয়ে গেলাম।
পরে আমার ছোট্ট হাত নিয়ে উনি নাড়াচাড়া করলেন। আর বললেন, যাও চা খাও। এটা ছিল ২০০২ সালের কথা। গুলশানে তার পুরনো বাড়িতে সালমা আপা মাঝে মধ্যেই আমাকে ডেকে পাঠাতেন। ধর্মের নানা খুঁটিনাটি আমার কাছ থেকে জেনে নিতেন।
সে ফাঁকে বাবুল সাহেবের সঙ্গেও আমার একটা পারিবারিক সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। একদিন সালমা আপা হঠাৎ করেই বললেন, আমি যেন তার তিন কন্যার কোরআন শরিফ পড়া ঠিক হয় কি না দেখে দিই। এভাবে এ পরিবারটির সঙ্গে আমার একটি আত্মার আত্মীয়তা গড়ে ওঠে।
যুগান্তরে কাজ করতে গিয়ে আমি দেখেছি বাবুল সাহেবকে প্রায় সব কর্মচারীই সমীহ করতেন। কিন্তু যখনই আমার সঙ্গে দেখা হতো উনি আগ বাড়িয়ে হেসে জিজ্ঞেস করতেন ‘মাওলানা কেমন আছ? সেনাকল্যাণে আসো না কেন?’ আমরা তখন মতিঝিলে বসি। সপ্তাহে দু’দিন আমার পাতা ইসলাম ও জীবন বের হয়। আমি একা একা ব্যস্ততা সামাল দিই।
হঠাৎ একদিন টেলিফোন এলো, এক পাঠক আমাকে প্রশ্ন করল- এই দোয়াটা সাতবার পড়ে যদি একটা বেহেশত পাওয়া যায়, আমি যদি আটবার পড়ি তাহলে কয়টা বেহেশত পাব? দুপুরবেলা হঠাৎ এমন টেলিফোন পেয়ে হকচকিয়ে থ হয়ে গেলাম।
আমি খুব বিরক্ত হয়ে রেগে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কে বলছেন? কোত্থেকে বলছেন? অপরপ্রান্ত থেকে বলা হল আমি নুরুল ইসলাম। মতিঝিল থেকে বলছি। মতিঝিল থেকে বলার সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে পড়ল, আরে! এটা তো আমাদের চেয়ারম্যান সাহেবের গলা।
তখন তিনি আমাকে বললেন, ‘মাওলানা! চা খাইতে আসো।’ আমি তার হৃদ্যতায় মুগ্ধ হয়ে গেলাম। যে মানুষ আমার সঙ্গে ভেতর জগতে এত হাসিখুশি মোলায়েম ব্যবহার করতেন এবং কী কারণে তিনি আমাকে এত পছন্দ করতেন এটা আমি নিজেই বিশ্বাসই হতো না। হয়তো তিনি আমার মধ্যে সোজাসাপটা একটা ব্যাপার দেখতে পেয়েছিলেন। যেখানে কোনো ঘোরপ্যাঁচ নেই।
তার ধর্মবোধ সম্পর্কে একটি উদাহরণ দিচ্ছি। এক সময় তিনি হজে গেলেন। তখন সালমা আপা আমাকে দায়িত্ব দিলেন আমি যেন তার সূরা কেরাত নামাজ এগুলো হয় কিনা একটু শুনে বোঝার চেষ্টা করি।
মক্কায় গিয়ে কোন কোন দোয়া পড়তে হবে, আল্লাহর কাছে কোন ভাষায় বলতে হবে এসব যেন আমি তাকে শিখিয়ে দিই। আমার আমতা আমতা ভাব দেখে এবং কাঁচুমাচু অবস্থা দেখে তিনি আমাকে বললেন, কী মাওলানা! কিছু বলবা?
আমি তখন বললাম, আপনি যে মক্কা যাবেন সেখানে গিয়ে ঠিকভাবে আল্লাহর কাছে মোনাজাত করা, হজের কাজগুলো কীভাবে করবেন... এতটুকু শুনেই তিনি মুচকি হেসে দিলেন।
বললেন, ‘মাওলানা! আল্লাহপাকের কাছে কি আলাদা কোনো ভাষায় কথা বলতে হবে? আল্লাহ কি তার বান্দার মনের ভাষা বোঝে না? আমি যে তার কাছে ক্ষমা চাইতে যাব, এটা কি আল্লাহ বোঝে না?’ বলেই হো হো করে হেসে দিলেন। এবং বললেন, ‘এসব দোয়া-দরুদ মৌলভী-মাওলানাদের জন্য। সাধারণ মানুষের মনের ভাষা আল্লাহ বোঝেন এবং আমি কী বলতে চাই তাও আমার আল্লাহ বোঝেন।’
আমি তার ধর্মবোধ দেখে তার কাছ থেকে মাঝে মধ্যেই গোপনে সবক নিয়েছি। মাঝে মধ্যেই তিনি টিঅ্যান্ডটি থেকে টেলিফোন করে পাঠকের জন্য কী হতে পারে এ পাতায়, কেমন লেখা দিলে পাঠকের সংখ্যা বাড়বে- এসব পরমার্শ আমাকে দিতেন।
এ সম্পর্ক ছিল আমাদের দু’জনের একান্ত গোপন ব্যাপার। বিষয়টা সালমা আপা জানতেন। আমি ভয়ে ভয়ে কখনোসখনো ধর্মকর্ম প্রসঙ্গ তুলতাম, তখন তিনি বলতেন, আমি যে মানুষের জন্য শিল্প কারখানা করছি, মানুষের কর্মের ব্যবস্থা করছি- এগুলো কি আল্লাহর কাজ না? তাহলে আমাকে আলাদা করে আবার আল্লাহর কাছে চাইতে হবে কেন? বলতে হবে কেন?
তিনি ভেতর জগতে আলেম সমাজকে খুব ভালোবাসতেন। মাঝে মধ্যেই তিনি আমার মাধ্যমে আলেমদের সমস্যা হলে বেশ থোক টাকা পাঠিয়ে দিতেন। হাফেজ্জী হুজুরের একটা বড় অনুষ্ঠানের সময় তিনি বিশাল বড় অঙ্কের অর্থ অনুদান দিয়েছিলেন।
এতে হাফেজ্জী হুজুরের ছেলেরা এবং আলেম সমাজ খুশি হয়ে তার জন্য দোয়া করেছেন এবং বলেছেন- এ মানুষটাকে দেখে বোঝা যায় না যে, তিনি ধর্মকে আলেম সমাজকে এত ভালোবাসেন। তিনি মাঝে মধ্যেই আলেম সমাজকে আমার মাধ্যমে সেনাকল্যাণে ডেকে পাঠাতেন।
এবং কোন ব্যবসা করা যায়, কোন ব্যবসা করা যাবে না- এমন খুঁটিনাটি বিষয় জেনে নিতেন। আলেমদের সঙ্গে বাহাস করা ছিল তার অভ্যাস। আলেমরা তার যুুক্তির কাছে হেরে যেতেন। তখন তারা বলতেন, তার চরিত্রের মধ্যে হজরত ওমরের ভাব আছে।
তিনি যা বলেন সোজাসাপটা বলেন। তার জীবনে কোনো ঘোরপ্যাঁচ নেই। তিনি সরাসরি আল্লাহওয়ালা। কিন্তু তার বাইরের সুরত দেখে বোঝা যায় না তিনি আল্লাহর প্রতি এত অগাধ বিশ্বাসী।
কোনো এক সময় একটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান বাবুল সাহেবের সঙ্গে দেখা করার জন্য আমাকে ধরে বসল। আমি যত তাকে এড়িয়ে যাই, ততই তিনি নাছোড়বান্দার মতো আমাকে পাকড়াও করেন। এক সময় অতিষ্ঠ হয়ে আমি বাবুল সাহেবকে বিষয়টা জানালাম যে, ওই ব্যাংকের চেয়ারম্যান আপনার সাক্ষাৎপ্রার্থী। আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান। বাবুল সাহেব পাঁচ মিনিটের জন্য সময় দিলেন।
নির্ধারিত দিনে ওই চেয়ারম্যান সাহেব এলেন। ভদ্রলোক যখন এলেন, বাবুল সাহেব তাকে বললেন, ইসলামের নামে ভণ্ডামী না করলে হয় না? ওই ভদ্রলোক হকচকিয়ে গেল। এভাবে মুখোমুখি একজন মানুষকে প্রশ্ন করা হয়তো তিনি আশা করেননি।
বাবুল সাহেব বললেন, ব্যাংকের নামের আগে ইসলামী ব্যাংক হবে কেন? ইসলামের নামে এই ভণ্ডামীর ব্যবসা করতে কে বলেছে আপনাদের? এটা ধর্মের কোথায় পেয়েছেন? ধর্ম নিয়ে টালবাহানা শিখেছেন কোত্থেকে? অন্য ব্যাংকগুলো যেমন ব্যবসা করে, আপনারাও সেভাবেই ব্যবসা করুন।
এখানে ইসলাম লাগালেন কেন? ইসলামের দোষ কী? ইসলামকে কেন কলুষিত করলেন? ব্যবসা তো অন্য ব্যাংকের মতোই করেন। এসব কথা শুনে ওই ভদ্রলোকের কান লাল হয়ে গেল। মুখ নিচু করে ফেললেন।
এ সময় হঠাৎ করেই চেয়ারম্যান সাহেব ওই ভদ্রলোককে বললেন, নেন নেন ছবি তোলেন। আপনার ক্যামেরাম্যানকে ডাকেন। ব্যাংকার মহোদয় যেন হাতে আকাশের চাঁদ পেলেন।
খুশিতে ডগমগ হয়ে বাইরে থেকে তার ক্যামেরাম্যানকে ডেকে আনলেন। চেয়ারম্যান সাহেবের সঙ্গে দুই তিন মিনিট ধরে ফটোসেশন করলেন। চেয়ারম্যান সাহেব হেসে হেসে লোকটার সঙ্গে ছবির পোজ দিলেন।
নুরুল ইসলাম। ইসলামের আলো এভাবেই হয়তো ভেতর জগত থেকে আলো ছড়ায়। এ আলো কেউ দেখে, বেশিরভাগ মানুষই দেখে না। নুরুল ইসলাম বাবুলকে আমি যতই দেখেছি, ততই মুগ্ধ হয়েছি।
আজ যখন তিনি নেই, তখন আমি আমার যত তেলাওয়াত আছে, যত দোয়া-দরুদ আছে, তার জন্য উৎসর্গ করছি। তার আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।
এই যুগান্তর যতদিন থাকবে, এই যমুনা টেলিভিশন যতদিন থাকবে, এই ফিউচারপার্ক যতদিন থাকবে; এর চেয়েও বেশিদিন তার স্মৃতি আমাদের মনে বেঁচে থাকবে, পাঠকের মনে বেঁচে থাকবে। এবং আমরা তার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করব, আল্লাহপাক যেন তাকে বেহেশত নসিব করেন।

লেখক: সাবেক বিভাগীয় সম্পাদক, দৈনিক যুগান্তর