অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবেন শিল্পপতি নুরুল ইসলাম
হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে দেশের কয়েকজন প্রখ্যাত শিল্পপতি, উদ্যোক্তা আমাদের মাঝ থেকে চিরবিদায় নিয়ে চলে গেছেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মোনেম গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা আবদুল মোনেম, ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান লতিফুর রহমান এবং যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম। সন্দেহ নেই, করোনার এ দুর্যোগকালে নিভৃতচারী এ তিন শিল্পোদ্যোক্তার মৃত্যুতে দেশের বড় এক ক্ষতি হয়ে গেল। কারণ, উল্লিখিত প্রত্যেক ব্যক্তিই জীবনকে মহিমান্বিত করে গেছেন দেশের হাজারও মানুষের জীবন-জীবিকার সংস্থান ও আরাধনা করে। জীবনের প্রতিটি ক্ষণই তারা কাটিয়েছেন কীভাবে মানুষের কর্মসংস্থান করা যায়-এ ভাবনা মাথায় রেখে।
সর্বশেষ আমরা হারিয়েছি শিল্পপতি নুরুল ইসলামকে। গত ১৩ জুন এ স্বনামখ্যাত ব্যবসায়ী আমাদের মাঝ থেকে চিরবিদায় নেন। আমাদের ব্যবসা-শিল্পজগতে সত্যিকার অর্থেই তিনি ছিলেন ব্যতিক্রম চরিত্রের এক উদ্যোক্তা। একেবারেই শূন্য থেকে ধীরে ধীরে তিনি শিল্পজগতে যেন এক ফুলের বাগান সাজিয়েছিলেন। নিজের সামর্থ্য দিয়ে ব্যবসা সম্প্রসারণ করেছিলেন। সারা দেশে তার হাতে গড়া মোট প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৪১। ম্যানুফ্যাকচারিং থেকে বিপণন-সবখানেই সাফল্য রেখেছেন। তিনি সবকিছুই করেছেন তিল তিল করে, নিজের বুদ্ধি আর পরিশ্রমের সংমিশ্রণে। গার্মেন্ট, ইলেকট্রনিক্স, বেভারেজ, নিটিং, মিডিয়া, মোটর- মূলত এসব খাতের মাধ্যমেই তিনি বিভিন্ন ধরনের সমৃদ্ধ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন, যেসব প্রতিষ্ঠানের পরিচিতি এখন দেশ-বিদেশে। ৭৪ বছরের জীবনে এতগুলো প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা মোটেও চাট্টিখানি কথা নয়। কেননা তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে কিছুই হাতে পাননি।
এ স্বনামধন্য শিল্পোদ্যোক্তা কত বড় স্বাপ্নিক ছিলেন, তার কিছু স্মারক রেখে গেছেন। এর মধ্যে অন্যতম যমুনা ফিউচার পার্ক। দৃষ্টিনন্দন এ শপিং মল এখন দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় শপিং মল হিসেবে পরিচিত। মিডিয়াজগতেও তিনি সফলতার ছাপ রেখেছেন। দৈনিক যুগান্তর এবং যমুনা টেলিভিশনের মধ্য দিয়েও শত শত সাংবাদিক আর কর্মীর কর্মসংস্থানের পথ তৈরি করেছেন। যুগান্তরের সম্পাদক সাইফুল আলম এবং যমুনা টিভির প্রধান বার্তা সম্পাদকের কাছেও শুনেছি এ দুটি প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ক্ষেত্রে যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম কতটা পেশাদারিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। আর এ কারণেই এই দুটি প্রতিষ্ঠান দ্রুত জনপ্রিয়তাও লাভ করে। বলতে দ্বিধা নেই, মিডিয়াজগতে এ দুটি প্রতিষ্ঠানই আস্থার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে।
নুরুল ইসলামের হাতে গড়া প্রতিটি প্রতিষ্ঠান সরকারের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকেছে। সরকারের নিয়মের বরখেলাপ করেনি। প্রতিবছর ট্যাক্স হিসেবে কোটি কোটি টাকা সরকারের কোষাগারে জমা দিয়েছে তার প্রতিটি প্রতিষ্ঠান। চারদিকে ফাঁকি দেয়ার প্রবণতা দেখা গেলেও নুরুল ইসলাম তার ব্যবসার ক্ষেত্রে নৈতিকতাকে সারা জীবন মান্য করেছেন। প্রতিষ্ঠানের কর্মীদেরও তা মান্য করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। সেই নৈতিকতার উল্লেখযোগ্য একটি হল খেলাপি সংস্কৃতিকে বর্জন করা। এ কারণে তিনি সরকারের নিয়ম অনুসরণ করেই ব্যাংকের ধার-দেনা পরিশোধ করতেন। তার মৃত্যুর পর সাবেক ব্যাংকারদের অনেকেই মন্তব্য করেছেন, তিনি খেলাপি সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী ছিলেন না। ব্যাংক থেকে তিনি যে অর্থ নিতেন তা সঠিক সময়ে পরিশোধ করার অনন্য উদাহরণ তার রয়েছে। প্রসঙ্গত বলতেই হয়, আমাদের একশ্রেণির ব্যবসায়ীর মধ্যে এখন ব্যাংক থেকে নানা কৌশলে টাকা নিয়ে তা ফেরত না দেয়ার সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। আবার অনেকেই নামে-বেনামে বিভিন্ন ভুয়া প্রতিষ্ঠান দেখিয়েও ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ করে বাজে নজির স্থাপন করেছেন। কিন্তু নুরুল ইসলাম প্রকৃতার্থে ব্যবসাতেই মনোযোগী থেকেছেন। সমসাময়িককালে তিনি অবশ্যই সাহসী, পরিশ্রমী, দেশপ্রেমিক এক শিল্পোদ্যোক্তা। তার কাছ থেকেই আমরা দেখেছি কীভাবে একের পর এক শিল্পকারখানা গড়ে তুলতে হয়। কীভাবে নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হয়। কীভাবে স্বদেশে উৎপাদিত পণ্য বিদেশের বাজারে বিক্রি করতে হয়। স্বল্পমূল্যে মানসম্পন্ন ইলেকট্রনিক্সের জিনিসপত্র তিনি পৌঁছে দেন মধ্যবিত্ত থেকে নিুবিত্তের ঘরে। তার হাতে গড়া যমুনা শিল্পগোষ্ঠীর যমুনা ফ্যান, ফ্রিজ, এলইডি টিভি, এয়ারকন্ডিশনার, মোটরসাইকেলের কদর এখন চতুর্দিকে। এসব পণ্যের চাহিদা এখন গ্রাম পর্যন্ত।
বহুমাত্রিক ব্যবসায়ী হিসেবে নুরুল ইসলাম আসলেই এক অনন্য উচ্চতায় নিজেকে নিতে পেরেছিলেন। অন্যদের থেকে এ মানুষটি ছিলেন একেবারেই ব্যতিক্রম। পরিশ্রম, একনিষ্ঠতা আর প্রত্যয়কে সম্বল করেই তিনি উচ্চাসনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। তার প্রয়াণের মধ্য দিয়ে একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটেছে সত্য; কিন্তু এখানেই শেষ নয়। এক নতুন দৃষ্টান্তও তিনি রেখে গেছেন। শুধু ব্যবসাই তিনি করেননি, জনগণের পাশেও দাঁড়িয়েছেন। দেশের দুর্যোগ-দুর্দিনে তিনি রাষ্ট্রকে সহযোগিতা করতে ভুল করেননি। এবার করোনা শুরু হওয়ার পর মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর তহবিলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ১০ কোটি টাকা প্রদান করে করোনা প্রতিরোধে এগিয়ে আসেন। শুনেছি একটি আন্তর্জাতিক মানের হাসপাতাল করার ইচ্ছা ছিল তার। সেটা করা হয়নি। তার উত্তরাধিকাররা সেটা করবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করছি।
শ্রদ্ধেয় নুরুল ইসলামের প্রয়াণের পর তার উত্তরাধিকারদের দায়দায়িত্ব এখন অনেক। তাদের অভিভাবক যে সাজানো সংসার রেখে গেছেন, তা আরও শোভিত ও সুসজ্জিত করার দায়িত্ব তাদেরই। আমি আশা রাখি, তারা তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবেন।
সবশেষে বলব, আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা হল কর্মসংস্থানের অভাব। দেশে প্রচুর জনশক্তি থাকলেও সেই অনুপাতে কর্মসংস্থান তৈরি হয়নি। এ কারণেই প্রতিবছর লাখ লাখ তরুণকে বেকারত্বের অভিশাপ নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়। একজন নুরুল ইসলাম সেই বেকারত্ব মোচনে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। অবশ্যই সে পথে তিনি এক সফল নায়ক। আমাদের ব্যবসা-শিল্পজগতে তিনি একটি ইতিহাস, একটি অনুপ্রেরণা। যে কথা বলেছেন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ।
স্পষ্টতই তিনি বলেছেন, নুরুল ইসলাম একজন স্বাপ্নিক ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা ছিলেন। এ ধরনের মানুষ প্রতিনিয়ত সমাজে জন্মগ্রহণ করে না। আমরা আশা করি, তার উত্তরাধিকাররা পিতার স্বপ্নকে আরও উচ্চতায় নিয়ে যাবেন। তার অসমাপ্ত স্বপ্নগুলো বাস্তবায়ন করে দেশবাসীর পাশে দাঁড়াবেন।
হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ : চেয়ারম্যান, ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি
kirondebate@gmail.com