‘ঋণখেলাপি না হয়েও যে সফল ব্যবসায়ী হওয়া যায় তা প্রমাণ করেছেন নুরুল ইসলাম’
ডা. জাহেদ উর রহমান
আমরা যারা অর্থনীতির খোঁজখবর রাখি, তারা জানি, পুরো ২০১৯ সাল বাংলাদেশের অর্থনীতির নিম্নগতি প্রত্যক্ষ করেছে। ২০১৯ সালে একমাত্র রেমিটেন্স ছাড়া সামষ্টিক অর্থনীতির আর সব সূচক, যেমন রফতানি আয়, আমদানির পরিমাণ (বিশেষ করে মূলধনী যন্ত্রপাতি), বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহ, অভ্যন্তরীণ ভোগ নিম্নগামী হয়ে পড়েছিল, যদিও সরকার ৮ শতাংশের বেশি জিডিপি প্রবৃদ্ধি দাবি করেছে তখন।
বাংলাদেশের অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি দেখে গত বছরই যৌক্তিকভাবে অনুমান করা যাচ্ছিল দেশের অভ্যন্তরে ভয়ংকর রকম দুর্নীতি আর অকল্পনীয় পরিমাণ টাকা পাচারের মাশুল আমরা হয়তো সহসাই দিতে যাচ্ছি। করোনা এসে সেটি ত্বরান্বিত করতে যাচ্ছে মাত্র।
পুঁজিতান্ত্রিক অর্থনীতিতে ব্যাংকব্যবস্থা রক্ত পরিবহনতন্ত্রের মতো কাজ করে। তাই এ খাতটি যদি সবল থাকে তাহলে আর কিছু ক্ষেত্রে দুর্বলতা থাকলেও সেটার ক্ষতি অনেক ক্ষেত্রেই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব; কিন্তু ব্যাংক ব্যবস্থাই যদি ভেঙে পড়ে তাহলে আর সবকিছু টিকে থাকার কোনো কারণ নেই। আমাদের অর্থনীতির কাঠামোগত দুর্বলতাগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আমাদের ব্যাংকিং খাতের চরম ঝুঁকি। খেলাপি ঋণ নামের এক ভয়ানক রোগ বছরের পর বছর এ দেশের ব্যাংকিং খাতকে ভেতর থেকে একেবারে ধ্বংস করে ফেলছে।
নানাভাবে চেষ্টা করে এ দেশে খেলাপি ঋণ লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা করা হয়; কাগজে-কলমে কম দেখানো হয়। গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকারি হিসাবে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা; যা মোট ঋণের ১১.৪ শতাংশ। এ হার দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ। কয়েক মাস আগে আইএমএফ জানিয়েছিল খেলাপি ঋণের প্রকৃত পরিমাণ এর চেয়ে অনেক বেশি- আড়াই লক্ষ কোটি টাকা।
কিছুদিন আগে তৈরি হওয়া আর্থিক খাতের ওপর বিশ্বব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল সেক্টর অ্যাসেসমেন্ট প্রোগ্রামের (এফএসএপি) প্রতিবেদনের খসড়া আমাদের সামনে এক ভয়াবহ চিত্র তুলে এনেছে। এতে বলা হয়েছে- স্থগিতাদেশ ঋণের হার ৪ দশমিক ১ শতাংশ, স্পেশাল মেনশন অ্যাকাউন্ট ৩ দশমিক ৭ শতাংশ এবং পুনঃতফসিলের অনাপত্তির হার ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। এসব বিবেচনায় খেলাপি ঋণসহ অর্থনীতিতে ‘প্রবলেম অ্যাসেট’র পরিমাণ ২৪ দশমিক ৮ শতাংশ। আমরা জানি এ ঋণের প্রায় পুরোটাই ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের কাছে, যারা ঋণ নেয়ার সময়ই জানতেন, এ ঋণ তারা ফেরত দেয়ার জন্য নিচ্ছেন না।
সার্বিক পরিস্থিতিতে বলা যায়, বাংলাদেশের কোনো বড় ধরনের অর্থনৈতিক ধস হবে আসলে ব্যাংকিং খাতের ধসের হাত ধরে। এ সত্য অনুধাবন করে খেলাপি ঋণের বিরুদ্ধে শক্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়া দূরেই থাকুক, সরকার একটার পর একটা প্রণোদনামূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের স্বার্থ রক্ষা করে।
এটা বলাই যায়, সরকারের সব নীতিমালা ঋণখেলাপিবান্ধব। এমন একটা অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় আমাদের বসবাস যেখানে আসলে মানুষকে ঋণখেলাপি হতে রীতিমতো প্ররোচনা দেয়া হয়। এখানে অবশ্য একটা বিষয় যুক্ত করা দরকার, এ প্ররোচনা মূলত ক্ষমতাশালী বড় ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের জন্য প্রযোজ্য। কারণ এ দেশে খুব ছোট ঋণ যারা নেন তাদের পক্ষে ঋণখেলাপি হওয়া প্রায় অসম্ভব ব্যাপার।
যুগান্তরে নিয়মিত সাপ্তাহিক কলাম লিখছি এক বছরের বেশি সময় হয়ে গেল। সেই হিসেবে নিজেকে যুগান্তর পরিবারের একজন সদস্য বলেই মনে করি। এ পরিবারের অভিভাবক দেশের বিশিষ্ট শিল্পোদ্যোক্তা জনাব নুরুল ইসলাম চলে গেলেন। এ মানুষটিকে বিশেষায়িত করা যায় নানা রকম বিশেষণে।
একজন মানুষ এতগুলো শিল্প, ব্যবসা তৈরি করে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে ভূমিকা পালন করেছেন, কর্মসংস্থান করেছেন হাজার হাজার মানুষের, এটি এক অসাধারণ ব্যাপার। নিজে ব্যবসা শুরু করে, সেই ব্যবসাকে দেশের সর্বোচ্চ একটা শিল্প এবং ব্যবসায়িক গ্রুপে পরিণত করে তিনি ভবিষ্যতের সব উদ্যোক্তাদের অন্যতম অনুকরণীয় আদর্শে পরিণত হয়েছেন।
এটি নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, এ সময়ের বাংলাদেশের মূলধারার গণমাধ্যম যথেষ্ট ‘ভাইব্র্যান্ট’ নয়। এর মধ্যে কিছু গণমাধ্যম ভূমিকা পালন করতে পারছে না, আবার কিছু মাধ্যম ইচ্ছা করেই সেটি করছে না। যারা ইচ্ছা করে সেটি করছে না তার কারণ আমরা জানি; কিন্তু যারা চাইলেও করতে পারছে না তার পেছনে তাদের কোনো না কোনো দুর্বলতা আছে যেটি দিয়ে সরকার তাদের ওপরে চাপ তৈরি করতে পারে।
ঠিক এমন একটা প্রেক্ষাপটে একেবারেই হাতেগোনা কয়েকটি মিডিয়া, যেগুলো অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছে, তার সংক্ষিপ্ততম তালিকায় জনাব নুরুল ইসলামের মালিকানায় থাকা সংবাদমাধ্যম যুগান্তর পত্রিকা এবং যমুনা টিভিকে রাখতেই হবে। এগুলো নানা ক্ষেত্রে সরকারের ভুল, দুর্নীতি, মানুষের মৌলিক অধিকার হরণ, এসব নিয়ে তথ্য এবং যুক্তিপূর্ণ অসাধারণ সব রিপোর্ট এবং বিশ্লেষণ মানুষের সামনে নিয়ে এসেছে। এভাবেই এ মিডিয়াগুলো নাগরিকদের স্বার্থরক্ষায় তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
একটা বৈরী সময়ে এমন ভূমিকা পালন করছে বলেই এটি খুব গুরুত্ব দিয়ে আলোচিত হবে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের গণমাধ্যমের ইতিহাসে। বর্তমান সময়ে অনেক গণমাধ্যম কেন সঠিক ভূমিকা পালন করতে পারছেন না সেটি নিয়ে কিছুক্ষণ আগে আমার বলা যুক্তি যদি সঠিক হয়, তাহলে বলতে হবে জনাব নুরুল ইসলামের সেই দুর্বলতাগুলো ছিল না। এ দুর্বলতাগুলোর মধ্যে প্রধান হচ্ছে কোম্পানির বিভিন্ন আইনগত এবং আর্থিক অনিয়ম, ভ্যাট-ট্যাক্স ফাঁকি আর একটা ‘ছোঁয়াচে রোগ’।
শুরুতে খেলাপি ঋণের যে প্রেক্ষাপটে আলোচনা করেছি, সেই আলোচনার প্রধান উপলক্ষ আসলে জনাব নুরুল ইসলাম। যত বড় শিল্প সাম্রাজ্যের অধিকারী তিনি ছিলেন, তার পক্ষে ঋণখেলাপি হয়ে যাওয়া কোনো সমস্যা ছিল না। এ দেশের অতি বড় বড় শিল্প গ্রুপ তো বটেই, মাঝারি মানের বহু প্রতিষ্ঠান ঋণখেলাপি হয়ে তাদের সম্পদ তৈরি করেছে। একটা রাষ্ট্রে যখন ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে ব্যবসা না করে সেই টাকা আত্মসাৎ করে ফেলা যায়, তখন খুব স্বাভাবিকভাবেই এটি কাউকে সৎভাবে ব্যবসা করে টাকা উপার্জন করা থেকে বিমুখ করতেই পারে। সে কারণেই একজন ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিকে দেখে আরেকজন ঋণখেলাপি হতে আগ্রহী হয়। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন এ কারণেই ঋণখেলাপি হওয়াকে তুলনা করেছেন ‘ছোঁয়াচে রোগ’-এর সঙ্গে।
এ রোগ আক্রান্ত করার প্রধান ঝুঁকি তার, যিনি ঋণখেলাপি হয়েও বহাল তবিয়তে থাকার মতো ক্ষমতা রাখেন। জনাব নুরুল ইসলাম সেরকম একজন মানুষই ছিলেন; কিন্তু না, তিনি নিজেকে মুক্ত রেখেছিলেন এ ভয়ংকর রাষ্ট্র ধ্বংসকারী ‘ছোঁয়াচে রোগটি’ থেকে।
মৃত্যুর সময়ও এক টাকা খেলাপি ছিলেন না, জনাব নুরুল ইসলামের মৃত্যুর পর এ শিরোনামে লিখেছেন খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। খেলাপি ঋণের বিরুদ্ধে ভীষণ সোচ্চার একজন ব্যাংকার আমাদের আরও জানান, তিনি শুধু খেলাপি ঋণ থেকে মুক্ত ছিলেন তা-ই না, তিনি খেলাপি ঋণ এবং টাকা পাচারের বিরুদ্ধে ভীষণ সোচ্চার ছিলেন এবং এ ব্যাপারে কাজ করতে সবসময় সবাইকে উৎসাহ জুগিয়েছেন।
জনাব নুরুল ইসলাম ভবিষ্যতের সব উদ্যোক্তার জন্য অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় হওয়ার কারণ হিসেবে এ লেখায় যা আগে বলেছি তার সঙ্গে যুক্ত করতে হবে এ অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টাও- ঋণখেলাপি না হয়েও এ দেশে সফল ব্যবসায়ী হয়ে অনেক ধনী মানুষ হওয়া যায়। তিনি প্রমাণ করেছেন একটা ঋণখেলাপিবান্ধব অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় থেকে, খেলাপি ঋণ নামে ছোঁয়াচে রোগে আক্রান্ত বহু মানুষের মধ্যে থেকেও এ রোগ থেকে মুক্ত থাকা যায়, এ রোগটির বিরুদ্ধে নিজে লড়াই করা যায়, অন্যকে লড়াই করার অনুপ্রেরণা দেয়া যায়।
ডা. জাহেদ উর রহমান : শিক্ষক, অ্যাক্টিভিস্ট
বাংলাদেশের অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি দেখে গত বছরই যৌক্তিকভাবে অনুমান করা যাচ্ছিল দেশের অভ্যন্তরে ভয়ংকর রকম দুর্নীতি আর অকল্পনীয় পরিমাণ টাকা পাচারের মাশুল আমরা হয়তো সহসাই দিতে যাচ্ছি। করোনা এসে সেটি ত্বরান্বিত করতে যাচ্ছে মাত্র।
পুঁজিতান্ত্রিক অর্থনীতিতে ব্যাংকব্যবস্থা রক্ত পরিবহনতন্ত্রের মতো কাজ করে। তাই এ খাতটি যদি সবল থাকে তাহলে আর কিছু ক্ষেত্রে দুর্বলতা থাকলেও সেটার ক্ষতি অনেক ক্ষেত্রেই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব; কিন্তু ব্যাংক ব্যবস্থাই যদি ভেঙে পড়ে তাহলে আর সবকিছু টিকে থাকার কোনো কারণ নেই। আমাদের অর্থনীতির কাঠামোগত দুর্বলতাগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আমাদের ব্যাংকিং খাতের চরম ঝুঁকি। খেলাপি ঋণ নামের এক ভয়ানক রোগ বছরের পর বছর এ দেশের ব্যাংকিং খাতকে ভেতর থেকে একেবারে ধ্বংস করে ফেলছে।
নানাভাবে চেষ্টা করে এ দেশে খেলাপি ঋণ লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা করা হয়; কাগজে-কলমে কম দেখানো হয়। গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকারি হিসাবে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা; যা মোট ঋণের ১১.৪ শতাংশ। এ হার দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ। কয়েক মাস আগে আইএমএফ জানিয়েছিল খেলাপি ঋণের প্রকৃত পরিমাণ এর চেয়ে অনেক বেশি- আড়াই লক্ষ কোটি টাকা।
কিছুদিন আগে তৈরি হওয়া আর্থিক খাতের ওপর বিশ্বব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল সেক্টর অ্যাসেসমেন্ট প্রোগ্রামের (এফএসএপি) প্রতিবেদনের খসড়া আমাদের সামনে এক ভয়াবহ চিত্র তুলে এনেছে। এতে বলা হয়েছে- স্থগিতাদেশ ঋণের হার ৪ দশমিক ১ শতাংশ, স্পেশাল মেনশন অ্যাকাউন্ট ৩ দশমিক ৭ শতাংশ এবং পুনঃতফসিলের অনাপত্তির হার ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। এসব বিবেচনায় খেলাপি ঋণসহ অর্থনীতিতে ‘প্রবলেম অ্যাসেট’র পরিমাণ ২৪ দশমিক ৮ শতাংশ। আমরা জানি এ ঋণের প্রায় পুরোটাই ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের কাছে, যারা ঋণ নেয়ার সময়ই জানতেন, এ ঋণ তারা ফেরত দেয়ার জন্য নিচ্ছেন না।
সার্বিক পরিস্থিতিতে বলা যায়, বাংলাদেশের কোনো বড় ধরনের অর্থনৈতিক ধস হবে আসলে ব্যাংকিং খাতের ধসের হাত ধরে। এ সত্য অনুধাবন করে খেলাপি ঋণের বিরুদ্ধে শক্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়া দূরেই থাকুক, সরকার একটার পর একটা প্রণোদনামূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের স্বার্থ রক্ষা করে।
এটা বলাই যায়, সরকারের সব নীতিমালা ঋণখেলাপিবান্ধব। এমন একটা অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় আমাদের বসবাস যেখানে আসলে মানুষকে ঋণখেলাপি হতে রীতিমতো প্ররোচনা দেয়া হয়। এখানে অবশ্য একটা বিষয় যুক্ত করা দরকার, এ প্ররোচনা মূলত ক্ষমতাশালী বড় ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের জন্য প্রযোজ্য। কারণ এ দেশে খুব ছোট ঋণ যারা নেন তাদের পক্ষে ঋণখেলাপি হওয়া প্রায় অসম্ভব ব্যাপার।
যুগান্তরে নিয়মিত সাপ্তাহিক কলাম লিখছি এক বছরের বেশি সময় হয়ে গেল। সেই হিসেবে নিজেকে যুগান্তর পরিবারের একজন সদস্য বলেই মনে করি। এ পরিবারের অভিভাবক দেশের বিশিষ্ট শিল্পোদ্যোক্তা জনাব নুরুল ইসলাম চলে গেলেন। এ মানুষটিকে বিশেষায়িত করা যায় নানা রকম বিশেষণে।
একজন মানুষ এতগুলো শিল্প, ব্যবসা তৈরি করে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে ভূমিকা পালন করেছেন, কর্মসংস্থান করেছেন হাজার হাজার মানুষের, এটি এক অসাধারণ ব্যাপার। নিজে ব্যবসা শুরু করে, সেই ব্যবসাকে দেশের সর্বোচ্চ একটা শিল্প এবং ব্যবসায়িক গ্রুপে পরিণত করে তিনি ভবিষ্যতের সব উদ্যোক্তাদের অন্যতম অনুকরণীয় আদর্শে পরিণত হয়েছেন।
এটি নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, এ সময়ের বাংলাদেশের মূলধারার গণমাধ্যম যথেষ্ট ‘ভাইব্র্যান্ট’ নয়। এর মধ্যে কিছু গণমাধ্যম ভূমিকা পালন করতে পারছে না, আবার কিছু মাধ্যম ইচ্ছা করেই সেটি করছে না। যারা ইচ্ছা করে সেটি করছে না তার কারণ আমরা জানি; কিন্তু যারা চাইলেও করতে পারছে না তার পেছনে তাদের কোনো না কোনো দুর্বলতা আছে যেটি দিয়ে সরকার তাদের ওপরে চাপ তৈরি করতে পারে।
ঠিক এমন একটা প্রেক্ষাপটে একেবারেই হাতেগোনা কয়েকটি মিডিয়া, যেগুলো অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছে, তার সংক্ষিপ্ততম তালিকায় জনাব নুরুল ইসলামের মালিকানায় থাকা সংবাদমাধ্যম যুগান্তর পত্রিকা এবং যমুনা টিভিকে রাখতেই হবে। এগুলো নানা ক্ষেত্রে সরকারের ভুল, দুর্নীতি, মানুষের মৌলিক অধিকার হরণ, এসব নিয়ে তথ্য এবং যুক্তিপূর্ণ অসাধারণ সব রিপোর্ট এবং বিশ্লেষণ মানুষের সামনে নিয়ে এসেছে। এভাবেই এ মিডিয়াগুলো নাগরিকদের স্বার্থরক্ষায় তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
একটা বৈরী সময়ে এমন ভূমিকা পালন করছে বলেই এটি খুব গুরুত্ব দিয়ে আলোচিত হবে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের গণমাধ্যমের ইতিহাসে। বর্তমান সময়ে অনেক গণমাধ্যম কেন সঠিক ভূমিকা পালন করতে পারছেন না সেটি নিয়ে কিছুক্ষণ আগে আমার বলা যুক্তি যদি সঠিক হয়, তাহলে বলতে হবে জনাব নুরুল ইসলামের সেই দুর্বলতাগুলো ছিল না। এ দুর্বলতাগুলোর মধ্যে প্রধান হচ্ছে কোম্পানির বিভিন্ন আইনগত এবং আর্থিক অনিয়ম, ভ্যাট-ট্যাক্স ফাঁকি আর একটা ‘ছোঁয়াচে রোগ’।
শুরুতে খেলাপি ঋণের যে প্রেক্ষাপটে আলোচনা করেছি, সেই আলোচনার প্রধান উপলক্ষ আসলে জনাব নুরুল ইসলাম। যত বড় শিল্প সাম্রাজ্যের অধিকারী তিনি ছিলেন, তার পক্ষে ঋণখেলাপি হয়ে যাওয়া কোনো সমস্যা ছিল না। এ দেশের অতি বড় বড় শিল্প গ্রুপ তো বটেই, মাঝারি মানের বহু প্রতিষ্ঠান ঋণখেলাপি হয়ে তাদের সম্পদ তৈরি করেছে। একটা রাষ্ট্রে যখন ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে ব্যবসা না করে সেই টাকা আত্মসাৎ করে ফেলা যায়, তখন খুব স্বাভাবিকভাবেই এটি কাউকে সৎভাবে ব্যবসা করে টাকা উপার্জন করা থেকে বিমুখ করতেই পারে। সে কারণেই একজন ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিকে দেখে আরেকজন ঋণখেলাপি হতে আগ্রহী হয়। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন এ কারণেই ঋণখেলাপি হওয়াকে তুলনা করেছেন ‘ছোঁয়াচে রোগ’-এর সঙ্গে।
এ রোগ আক্রান্ত করার প্রধান ঝুঁকি তার, যিনি ঋণখেলাপি হয়েও বহাল তবিয়তে থাকার মতো ক্ষমতা রাখেন। জনাব নুরুল ইসলাম সেরকম একজন মানুষই ছিলেন; কিন্তু না, তিনি নিজেকে মুক্ত রেখেছিলেন এ ভয়ংকর রাষ্ট্র ধ্বংসকারী ‘ছোঁয়াচে রোগটি’ থেকে।
মৃত্যুর সময়ও এক টাকা খেলাপি ছিলেন না, জনাব নুরুল ইসলামের মৃত্যুর পর এ শিরোনামে লিখেছেন খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। খেলাপি ঋণের বিরুদ্ধে ভীষণ সোচ্চার একজন ব্যাংকার আমাদের আরও জানান, তিনি শুধু খেলাপি ঋণ থেকে মুক্ত ছিলেন তা-ই না, তিনি খেলাপি ঋণ এবং টাকা পাচারের বিরুদ্ধে ভীষণ সোচ্চার ছিলেন এবং এ ব্যাপারে কাজ করতে সবসময় সবাইকে উৎসাহ জুগিয়েছেন।
জনাব নুরুল ইসলাম ভবিষ্যতের সব উদ্যোক্তার জন্য অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় হওয়ার কারণ হিসেবে এ লেখায় যা আগে বলেছি তার সঙ্গে যুক্ত করতে হবে এ অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টাও- ঋণখেলাপি না হয়েও এ দেশে সফল ব্যবসায়ী হয়ে অনেক ধনী মানুষ হওয়া যায়। তিনি প্রমাণ করেছেন একটা ঋণখেলাপিবান্ধব অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় থেকে, খেলাপি ঋণ নামে ছোঁয়াচে রোগে আক্রান্ত বহু মানুষের মধ্যে থেকেও এ রোগ থেকে মুক্ত থাকা যায়, এ রোগটির বিরুদ্ধে নিজে লড়াই করা যায়, অন্যকে লড়াই করার অনুপ্রেরণা দেয়া যায়।
ডা. জাহেদ উর রহমান : শিক্ষক, অ্যাক্টিভিস্ট