Loader
শিক্ষা, শান্তি, সেবা ও সামাজিক উন্নয়নই নুরুল ইসলাম ফাউন্ডেশন-এরমূল লক্ষ্য। পারস্পরিক সহযোগিতা, সহমর্মিতা, ভ্রাতৃত্ববোধ ও পরোপকার-এর মাধ্যমে বিশ্বমানবতার কল্যাণই আমাদের একমাত্র ব্রত। আর্তমানবতার সেবা, সমাজ সংস্কার, কর্মসংস্থান তৈরি, শিক্ষা উপকরণ বিতরণ, দারিদ্র্য বিমোচন, এতিম, গরিব, বয়স্ক, বিধবা ও প্রতিবন্ধীদের ভরণপোষণ, ছিন্নমূল ও পথবাসীদের পুনর্বাসন, ত্রাণ বিতরণ, স্বাস্থ্যসেবা প্রদানসহ সব শ্রেণির নাগরিকদের নৈতিক ও চারিত্রিক উন্নয়নের মাধ্যমে একটি সমৃদ্ধ ও স্বনির্ভর দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখি আমরা।

তাকে যেমন দেখেছি


মনোয়ার রুবেল


ব্যবসায়ীদের প্রতি আমার ভক্তি-শ্রদ্ধা আলাদা। কারণ হচ্ছে, একজন ব্যবসায়ীর নিজের ভাগ্য পাল্টালে তার সঙ্গে সঙ্গে শত শত মানুষের ভাগ্য পাল্টে যায়। কতগুলো ইন্ডাস্ট্রি দাঁড়ায়। হাজার হাজার মানুষ কাজ পায়। তাদের পরিবারে সচ্ছলতা আসে।
আমি সরাসরি তার অধীনস্থ একটি ইউনিটে কাজ করেছিলাম ২০০৯ থেকে ২০১১ পর্যন্ত। ইউনিটে আমি সবচেয়ে জুনিয়র ছিলাম। সদ্য অনার্স পরীক্ষা দিয়েছি। তখনও রেজাল্ট প্রকাশিত হয়নি। সে সময় তিনি হাউজিং বিজনেস করছেন। খিলক্ষেতে প্রচুর জমি কিনছেন। এক জমি তিন ভাইয়ের কাছ থেকে তিনবার কিনতেও দেখেছি। নগদ টাকা দিয়ে কেনা। বহু দাগে দেখেছি, জমির পরিমাণের চেয়ে কাগজে-কলমে তার কেনা জমির পরিমাণ বেশি। তা কীভাবে সম্ভব? অনেক সময় ভাইয়ে-ভাইয়ে দ্বন্দ্ব করে আগে পরে জমা-খারিজ করতেন। তিনি প্রতিবারই যে ভাই জমি বিক্রি করতে এসেছেন, তার জমি কিনে নিয়েছেন। তিনি জানতেন- তিনি ঠকছেন; কিন্তু ব্যবসায়ে এক ইঞ্চিও ফাঁকফোকর তিনি রাখতেন না। তার প্রজেক্ট নিয়ে পরে মামলা হতে পারে, ঝামেলা হতে পারে, বদনাম হতে পারে; তাই তিনি জেনেশুনে এক জমি একাধিকবারও কিনতেন। ব্যবসা যতটা সম্ভব নির্ভেজাল-পরিচ্ছন্ন রাখতেন।
অবাক বিষয় ছিল তার আশ্চর্য স্মৃতিশক্তি। বরুয়া, জোয়ারসাহারা, ডুমনি- এসব এলাকায় আরও কিছু মৌজায় প্রত্যেকটি দাগ, খতিয়ান, জমির মালিকের নাম সব তার মুখস্থ। আমরা ম্যাপ বের করতাম। তিনি মুখস্থ বলতেন। হাজার হাজার দাগ মুখস্থ। মালিকের নাম মুখস্থ। শুধু খিলক্ষেত প্রজেক্ট নয়, আশুলিয়াতে ৭-৮টি মৌজা- সেগুলোও দেখতাম, প্রায়ই গড়গড় করে বলতেন। যমুনা গ্রুপের ৪১টি প্রতিষ্ঠান- সবগুলোর সবকিছুই নাকি এমনভাবেই মুখস্থ ছিল তার।
আরেকটি জিনিস- তিনি আমাদের ইউনিট প্রধান ছিলেন। তাই তখন টিএ বিলেও তিনিই স্বাক্ষর করতেন। দুই বছরের চাকরি জীবনে কখনও বিলে কাটাকাটি করতে দেখিনি। কেউ যে দু-একশ’ টাকা বেশি লিখতেন না, তা নয়। তিনি হয়তো বিষয়টি জানতেনও। কিন্তু কোনোদিন কিছু জিজ্ঞেস করতেন না। দু-একশ’ টাকা নিয়ে কথা বলার মতো ক্ষুদ্র মানুষ তিনি ছিলেন না।
আরেকবার আমাদের সবচেয়ে সিনিয়র এক কলিগ মান্নান ভাইকে খিলক্ষেত প্রজেক্টে বদলি করার কথা হল। তিনি ১৯৬৭ সালে এসএসসি পাস করেছেন। এ থেকে পাঠক তার বয়স বুঝতে পারবেন। তিনি বয়স্ক মানুষ, তাই সেখানে যেতে গাঁইগুঁই করছিলেন। তখন নুরুল ইসলাম সাহেব বললেন, ওকে; তাকে বেতন বাড়িয়ে সেখানে পোস্টিং দাও। তখন ৫ বা ১০ হাজার টাকা বেতন বাড়িয়ে দেয়া হল। ওই সময়কালে এ বৃদ্ধির হারকে যথেষ্ট ভালো বলা চলে। বিকেলে বদলি আদেশ রদ করা হল। নুরুল ইসলাম সাহেব বুঝলেন, মান্নান সাহেব সত্যিই বয়স্ক মানুষ। তার জন্য এ পোস্টিং কষ্টকর হয়ে পড়বে। তাই তার জায়গায় নতুন আরেকজনকে বদলি করা হল। তার বেতনও বাড়িয়ে দেয়া হল। দেখা গেল, মান্নান সাহেবের বদলির আদেশ বাতিল হলেও বেতন বাড়ানোর যে কথা নুরুল ইসলাম সাহেবের মুখ দিয়ে বেরিয়েছে, তা বাতিল হল না; কারণ তিনি মালিক। তার মুখের জবানের একটা ওজন আছে, এটি তিনি বিশ্বাস করতেন। বলা ভালো, মান্নান সাহেবের বেতনও কমেনি। মান্নান সাহেব ২০১৪ সালে মারা যান।
একটি ঘটনার কথা প্রায়ই আমি বলি। একদিন কী একটা কাজে খুব জরুরি একটি চিঠির প্রিন্ট নিয়ে তার রুমে ঢুকলাম। এক কাগজের এপিঠ-ওপিঠ প্রিন্ট দেয়া। তিনি আমাকে গম্ভীর গলায় জানতে চাইলেন- এভাবে এপিঠ-ওপিঠ কেন প্রিন্ট দিয়েছি? আমি বললাম- কাগজ বাঁচাতে। তিনি বললেন- এতে বছরে কত টাকা বাঁচাতে পারবি? দুইশ’ টাকা? দুই-চার টাকার দিকে তাকালে হাজার কোটি টাকার বিজনেস করতে পারবি না। হাজার কোটি টাকার দিকে খেয়াল রাখতে হবে। ঠিক আছে?
‘জ্বি’ বলে আমি বেরিয়ে এলাম। শিখলাম, দু-এক টাকা বাঁচিয়ে কোটি টাকা আয় করা যায় না; এজন্য কোটি টাকার লক্ষ্য থাকতে হয়। কাকতালীয় মনে হতে পারে- সেদিন বিকেলে হঠাৎ করে বিশ্ববাজারে সুতার দাম বেড়ে যাওয়ার খবর এলো। তাতে যমুনার শতকোটি টাকার মতো আয় হবে শুনেছিলাম।
নুরুল ইসলাম সাহেবকে নিয়ে শেষ ঘটনাটি বলি। একবার কোনো এক পার্টি আমাদের টিমের বিরুদ্ধে নালিশ দিল। ভদ্রলোক সম্ভবত আমাদের কাছে ভালো ব্যবহার পাননি। যথারীতি চেয়ারম্যান সাহেব আমাদের পুরো টিমকে (প্রায় ১৪ জন) তার রুমে ডাকলেন, এখনকার যমুনা টেলিভিশন ভবনের নিচতলায়। বকা খাওয়ার ভয়ে আমরা অস্থির। এমন কী চাকরিও চলে যেতে পারে।
সেদিন কিন্তু তিনি কোনো রাগই দেখালেন না। নবাবগঞ্জের আঞ্চলিক টানে কিছু কথা বললেন। কথাগুলো ছিল এরকম- আমার রুমের দরজা কখনও বন্ধ দেখছোস রে? আমার দরজা সবার জন্য খোলা। আমার রুমে তো লুঙ্গি পইরা, স্যান্ডেল পইরা, ফাঁড়া গেঞ্জি পইরা যে কেউ ঢুইক্যা পড়ে। আমারে কখনও তাগোরে বাইর কইরা দিতে দেখছোস? আমার লেনদেন তো তাগো লগে। তারা না থাকলে আমার কোনো অস্তিত্ব আছে? আমি তো ডিসি না, এমপি না, মন্ত্রী না। আমি তোগো মালিক হইয়া যদি এসব সহ্য করি, তোরা কেন তাদের ঢুকতে দিস না? মন দিয়া শুন্, তাগোরে সাহায্য করবি। সার্ভিস দিবি। আমরা ব্যবসা করি মানুষের লগে। মানুষ তো আমগো কাছেই আইবো। তাই না?
প্রতিটি শব্দ তিনি যখন বলছিলেন- গলা এত চমৎকারভাবে ওঠানামা করছিল; সত্যি কথা বলতে কী, আমি এর আগে বা পরে জীবনে এত চমৎকার মোটিভেশনাল স্পিচ শুনিনি।

মনোয়ার রুবেল : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট