Loader
শিক্ষা, শান্তি, সেবা ও সামাজিক উন্নয়নই নুরুল ইসলাম ফাউন্ডেশন-এরমূল লক্ষ্য। পারস্পরিক সহযোগিতা, সহমর্মিতা, ভ্রাতৃত্ববোধ ও পরোপকার-এর মাধ্যমে বিশ্বমানবতার কল্যাণই আমাদের একমাত্র ব্রত। আর্তমানবতার সেবা, সমাজ সংস্কার, কর্মসংস্থান তৈরি, শিক্ষা উপকরণ বিতরণ, দারিদ্র্য বিমোচন, এতিম, গরিব, বয়স্ক, বিধবা ও প্রতিবন্ধীদের ভরণপোষণ, ছিন্নমূল ও পথবাসীদের পুনর্বাসন, ত্রাণ বিতরণ, স্বাস্থ্যসেবা প্রদানসহ সব শ্রেণির নাগরিকদের নৈতিক ও চারিত্রিক উন্নয়নের মাধ্যমে একটি সমৃদ্ধ ও স্বনির্ভর দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখি আমরা।

তিনি বেঁচে থাকবেন তার মহৎ কর্মের মাঝে


সফল ব্যবসায়ী, শিল্প খাতের সফল উদ্যোক্তা, মিডিয়াবান্ধব, মুক্তিযোদ্ধা এবং প্রকৃত মানব ও দেশপ্রেমিক জনাব নুরুল ইসলাম ১৩ জুলাই মহান স্রষ্টার ডাকে সাড়া দিয়ে লাখো মানুষকে কাঁদিয়ে পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন আর রেখে গেছেন তার অমর সৃষ্টি, দেশ ও মানুষকে ভালোবাসার চরম দৃষ্টান্তগুলো। আমরা শ্রদ্ধা জানাই বিরল ব্যক্তিত্বের অধিকারী এ মানুষটিকে, যিনি ১৯৭৪ সালে শূন্য থেকে যাত্রা শুরু করেছিলেন।

আমরা জানি ১৯৭৪ সালে দেশ চরম দুর্ভিক্ষের কবলে পড়েছিল আর সেই মুহূর্তে নুরুল ইসলামের মতো ব্যক্তিত্ব কীভাবে মানুষকে অনাহার থেকে, দুর্ভিক্ষ থেকে, অর্থনৈতিক টানাপোড়েন থেকে মুক্তি দেয়া যায় সেই মিশন নিয়ে শুরু করেছিলেন তার ব্যবসা। ধীরে ধীরে, ঐকান্তিক প্রচেষ্টা, সততা, সৃজনশীলতা ও মানুষের ভালোবাসা তাকে ব্যবসার শীর্ষে অবস্থান করার সম্মান এনে দিয়েছে। আমরা যতটা জানি, যমুনা গ্রুপে প্রায় ৫০ হাজার লোক কাজ করেন। এ ৫০ হাজার মানুষের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যদি ৪ জন করেও মানুষ উপকৃত হয়, তাহলে ২ লাখ মানুষ, পরোক্ষভাবে নিশ্চয়ই ৮-১০ জন করে মানুষ এর উপকারভোগী। তার মানে হচ্ছে ৪-৫ লাখ লোক এর উপকারভোগী। আর সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে আরও কয়েক লাখ লোক এর সঙ্গে সম্পৃক্ত। তার সৃষ্টি, দর্শন এবং কোটি কোটি মানুষের প্রেরণা এবং নতুন কিছু করার, দেশকে ভালোবাসার উৎস।
জনাব নুরুল ইসলাম ছিলেন দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীদের মধ্যে একজন। কিন্তু তার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য, তার ব্যবসার আলাদা নীতি এবং দর্শন বর্তমান প্রজন্মের জন্য বিশাল শিক্ষণীয় বিষয়। কারণ আমরা দেখি, যারাই অর্থ-বিত্তের মালিক হন, যারাই একটু প্রভাবশালী হন তারাই বিদেশের মাটিতে গড়ে তোলেন অজস্র সম্পদের পাহাড়, গড়ে তোলেন বিদেশি ব্যাংকে কোটি কোটি ডলারের ব্যাংক ব্যালান্স। অথচ এ মানুষটি ওসব পথের কথা চিন্তাও করেননি। তার ব্যবসার দর্শনই আলাদা। আমাদের দেশে এমন ব্যবসায়ীরই দরকার। দেশকে যারা কিছু দিতে পারেন, মানুষের জন্য যারা কাজ করতে পারেন জাতি তো তাদের স্মরণ করবেই। কত মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে তার প্রতিষ্ঠিত মিডিয়া সেন্টারে, কল-কারখানায়! কত বেকারের কর্মসংস্থান হয়েছে! তিনিই তো আসল দেশপ্রেমিক। তিনি ৪১টি প্রতিষ্ঠানের মালিক, অথচ তার জীবনযাপন ছিল সাধারণ। আমরা দেখি অনেকেই বিদেশে টাকা পাচার করেন, বিদেশে প্রতিষ্ঠান করেন, তাতে দেশের লাভ কী? দেশের বরং অপরিমেয় ক্ষতি করে অনেক বড় ব্যবসায়ী বিদেশে বিশাল বিত্তের মালিক হন। তাদের অনেক কিছু শেখার আছে নুরুল ইসলামের কাছ থেকে। দেশের অর্থনীতিতে যে ভূমিকা তিনি রেখেছেন তা অবিস্মরণীয়। তার অর্জিত সব অর্থই তিনি দেশে বিনিয়োগ করেছেন। বিদেশের ব্যাংকে টাকা রাখেননি। এটিই তো বড় দেশপ্রেমের উদাহরণ। আমি ব্যক্তিগতভাবে স্যালুট করি নুরুল ইসলামকে।
আর একটি কথা, দেশে শীর্ষ ব্যবসায়ীর সংখ্যা অনেক আছে, অনেকেরই অর্থ-বিত্ত আছে কিন্তু মানুষের জন্য, দেশের কল্যাণের জন্য কে কতটা করেন সেটি দেখার বিষয়। আমরা এই ব্যক্তিত্বের ভেতর সেটি দেখলাম, তার অর্থও ছিল, মনও সে রকম উদার ও বড়। মানুষের জন্য কিছু করার আকাঙ্ক্ষা, বাসনা সবার থাকে না, সবাই পারে না, তিনি পেরেছেন। তাই মানুষ তাকে স্মরণ করবেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ও জনতা ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুরশিদ কুলী খান এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম একজন ভালো গ্রাহক ছিলেন। তিনি কখনও ঋণ পুনঃতফসিল বা সুদ মওকুফ চাননি। শিল্প খাতে এ আইকনকে ব্যবসায়ী সম্প্রদায় মিস করবে।’ আমাদের সম্মুখে রাষ্ট্রীয় ঋণখেলাপিদের সংখ্যা এবং ঘটনা অহরহ দেখছি। এ মানুষটি ছিলেন তার বিপরীত।

মিডিয়া জগতে তার প্রতিষ্ঠিত ‘যুগান্তর’ সত্যিই মানুষের মন জয় করেছে, পৌঁছে গেছে গণমানুষের কাছে। ইলেকট্রনিক মিডিয়াতেও পিছিয়ে নেই তিনি। তৈরি করেছেন যমুনা টিভি, এটিও গণমানুষের কাছে চলে গেছে। কোয়ালিটি প্রোগ্রাম তৈরি করছে এই চ্যানেলটি। আর এগুলো করতে তার অনেক কষ্ট করতে হয়েছে, ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। যমুনা ফ্যানের কথা আমরা সবাই জানি, তিনি নাকি এটি দিয়েই ব্যবসা শুরু করেছিলেন।
বিভিন্ন জনের কাছ থেকে জেনেছি, তিনি শুধু তার শিল্পপ্রতিষ্ঠান দিয়ে নয়, মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন বিভিন্নভাবে। অনেককে সহায়তা করেছেন গোপনে। একজন সফল ও কৃতী ব্যবসায়ী হিসেবে তিনি মানুষের কল্যাণে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক ও সমাজসেবামূলক কাজে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ও দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে তিনি ছিলেন আধুনিক চিন্তার সাহসী উদ্যোক্তা। একজন সাহসী ও চ্যালেঞ্জিং উদ্যোক্তা হিসেবে তিনি মানুষের মণিকোঠায় অমর হয়ে থাকবেন। একের পর এক নতুন নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছেন আর মোকাবেলা করেছেন বহুমুখী চ্যালেঞ্জের। অনেক খাতে তিনিই প্রথম বিনিয়োগকারী। এত প্রতিকূলতার মধ্যেও বড় মাপের ব্যবসায়ী হয়ে তিনি কখনও ঋণখেলাপি ছিলেন না। ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে টালবাহানা করার কোনো রেকর্ড তার নেই, যেমনটি আমরা অনেক ব্যবসায়ীর ক্ষেত্রে দেখে থাকি।

তিনি নিজের মতো করেই একটি জগৎ সৃষ্টি করেছিলেন, যা বাংলাদেশের শিল্পোদ্যোক্তাদের জন্য শিক্ষণীয়। তার কোনো বিদেশি পাসপোর্টও ছিল না। দেশ নিয়েই চিন্তা করতেন। দেশ ও মানুষও তাই তাকে নিয়ে চিন্তা করবে, তাকে মনে রাখবে। এ স্বপ্নসারথি কর্মজীবী ও মেহনতি মানুষের মধ্যে বেঁচে থাকবেন চিরদিন। তিনি অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। কঠোর পরিশ্রম করে বহুমুখী শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটিয়েছেন। একজন ব্যবসায়ী নিজের ভাগ্য পাল্টালে সঙ্গে সঙ্গে অনেকের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটে, সেই ল্যাবরেটরি তিনি বানিয়েছেন যমুনা গ্রুপে। এ ধরনের বড় মানুষষের অনেক কিছু থাকে। তার আশ্চর্য ধরনের স্মৃতিশক্তি যমুনা গ্রুপের অনেককে অবাক করেছে। তার এক কর্মীর মন্তব্য- ‘বরুয়া, জোয়ারসাহারা, ডুমনি- এসব এলাকায় আরও কিছু মৌজায় প্রত্যেকটি দাগ, খতিয়ান, জমির মালিকের নাম সব তার মুখস্থ। আমরা ম্যাপ করতাম। তিনি মুখস্থ বলতেন। হাজার হাজার দাগ মুখস্থ। মালিকের নাম মুখস্থ। শুধু খিলক্ষেত প্রজেক্ট নয়, আশুলিয়াতে ৭-৮টি মৌজা- সেগুলোও দেখামাত্র গড়গড় করে বলতেন। যমুনা গ্রুপের ৪১টি প্রতিষ্ঠান- সবগুলোর সবকিছুই নাকি এমনভাবে মুখস্থ ছিল তার।’

সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে, বিশেষ করে সাধারণ মানুষের সঙ্গে তার আচরণ উদাহরণযোগ্য। একবার কোনো এক পার্টি যমুনা গ্রুপের কোনো এক ইউনিট থেকে কাঙ্ক্ষিত আচরণ পাননি। তাই তারা অভিযোগ জানিয়েছেন। চেয়ারম্যান স্বয়ং যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে তাদের আলাদাভাবে ডেকেছেন। তারা প্রায় ১৪ জন ছিলেন। সবাই নাকি আতঙ্কে ছিলেন আজকে কার চাকরি যায় আর কার থাকে। চমৎকারভাবে তিনি বলেছেন, ‘এসব মানুষ না থাকলে আমার কোনো অস্তিত্ব আছে? আমি তো ডিসি না, এমপি না, মন্ত্রী না। আমি তোমাগো মালিক হইয়া যদি এসব সহ্য করি, তাহলে তোমরা কেন তাদের তোমাদের রুমে ঢুকতে দেও না। আমরা ব্যবসা করি মানুষের জন্য। মানুষ তো আমাদের কাছে আসবেই। তাহলে তাদের সঙ্গে অন্যরকম আচরণ কেন প্রদর্শন করছ?’ এগুলোই তো একজন প্রকৃত মানুষের কথা, এটিই তো একজন নেতার কথা, এটিই তো একজন বিশিষ্ট ও প্রথমসারির ব্যবসায়ীর কথা।
নতুন নতুন উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী, তরুণ এবং পদস্থ কর্মকর্তাদেরও এখান থেকে বহু কিছু শেখার আছে। সবারই নিজ নিজ দায়িত্ব আছে, সবাই কোনো না কোনো ধরনের মানুষের চাহিদা মেটানোর জন্য, প্রয়োজন মেটানোর জন্য, সেবা দেয়ার জন্য এ সমাজে কাজ করছেন। কাজেই সমাজের মানুষের সঙ্গে, সাধারণ মানুষের সঙ্গে আচরণ করতে হবে সেবার মনোভাবে নিয়ে। আমাদের তিনি এ শিক্ষা দিয়ে গেছেন থিওরি দিয়ে নয়, নিজে দেখিয়ে দিয়েছেন। এটিই মহৎ ব্যক্তিদের গুণ! সেদিনকার কর্মচারীদের মুখে বলা উক্তি হচ্ছে এরূপ, ‘এত চমৎকার মোটিভেশনাল স্পিচ জীবনে আর শুনিনি।’ তাকে যারা কাছ থেকে দেখেছেন, তার সঙ্গে যাদের কাজ করার সুযোগ হয়েছে আমি বলব তারা সবাই আলাদা ধরনের ভাগ্যবান। শিক্ষা শুধু বইয়ে থাকে না, শিক্ষা গ্রহণ করতে হয় প্রকৃতি থেকে, পারিপার্শ্বিকতা থেকে, অভিজ্ঞতা থেকে, মহৎ ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্যে এসে। এসব ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্য বহু মানুষের জীবনকে পাল্টে দেয়, দিয়েছে এবং দেবে। পরপারে ভালো থাকুন জনাব নুরুল ইসলাম। আপনার মহৎ কর্ম আপনাকে যুগ যুগ মানুষের মাঝে, দেশের মাঝে বাঁচিয়ে রাখবে আর মানুষের মনে নতুন নতুন আশা জাগাবে, নতুন নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টির পথ দেখাবে।

মাছুম বিল্লাহ : ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত ভাইস প্রেসিডেন্ট: সাবেক ক্যাডেট কলেজ, রাজউক কলেজ ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক
masumbillah65@gmail.com